No Image

   

00:00
00:00
Volume

 0 Songs

    জাতক গাছের গল্প

    জাতক গাছের গল্প

    Story image

    পরিমলদা আশ্চর্য একটা গল্প বলেছিলেন। অধ্যাপক ও বিশিষ্ট লেখক পরিমল ভট্টাচার্য। পাহাড়ে-পাহাড়ে ঘোরা যাঁর আজন্ম নেশা। মৌলানা আজাদ কলেজের স্টাফ রুমে বসে তিনি শুনিয়েছিলেন পিটার উলেহভেন নামের এক পাগল জার্মানের গল্প। গাছ-পাগল। বনে বনে ঘোরেন। গাছেদের সঙ্গে কথা বলেন। পিটার বলেন-- হ্যাঁ, গাছেরা সাড়া দেয়। একে অপরের সঙ্গে বিনিময় করে ভাষা, প্রাণ। প্রাণ? তাও হয়? 'দ্য হিডেন লাইফ অব ট্রিজ' নামের বইতে সেই গল্পই বলেছেন পিটার।

    বনে ঘুরতে ঘুরতে একদিন লতাপাতায় ঢাকা একটা গোলাকার পাথুরে জিনিস চোখে পড়ে পিটারের। তাকে চারপাশ থেকে ঘিরে আছে বেশকয়েকটা উঁচু উঁচু গাছ। এই অঞ্চলে অনেক পুরোনো গাছের ঢল। তাদেরই কয়েকটার যদি হদিশ মেলে, তাই ঘুরছিলেন পিটার। যাকে পাথর মনে হচ্ছিল প্রথমে, পিটার দেখলেন তাও আসলে একটা পুরোনো গাছের গুঁড়ি। অনেক অনেক বয়সের পুরোনো একটা প্রকাণ্ড গাছ। মরেও গেছে অনেকদিন। ভেঙেচুরে শুধু নিষ্প্রাণ গুঁড়িটুকুই পড়ে আছে। কিন্তু না। গুঁড়ির নিচে এখনও সবুজ। ক্লোরোফিল। মানে প্রাণ আছে। পিটার অবাক হয়ে ভাবেন-- এ কী করে সম্ভব! গাছটার কাণ্ড নেই, পাতা নেই, শুধু গুঁড়ি কী করে বেঁচে থাকে?

    তারপর যা তাঁর চোখে পড়ে সে এক অলীক বাস্তব। চারপাশের গাছেদের শিকড়গুলো বয়ে বয়ে এসে মিশেছে ওই গুঁড়িতে। তাদের থেকে জীবনরস পেয়ে মরে গিয়েও বেঁচে আছে সেই চারভাগের তিনভাগ ধ্বংস হয়ে যাওয়া গাছের গুঁড়ি। ক্লোরোফিল জন্মেছে নতুন করে। মরে যাওয়া বুড়ো গাছটাই বাঁচছে ফের। তাকে বাঁচিয়ে রাখছে বনের অন্যান্য গাছ। বলছে-- থেকে যাও। যেতে নাহি দিব। যেন একটা পুরোনো ঐতিহ্য বাঁচিয়ে রাখার প্রাণপণ চেষ্টা করছে গোটা বন...

    টিম ফ্ল্যানারি কদিন আগে আমাদের জানিয়েছিলেন, গাছেরা কথা বলে। ভাষা বিনিময় করে। শিকড়ে শিকড়ে যে চোরা ইলেকট্রন প্রবাহ চলে গাছেদের তার কারণ তারা ভাব বিনিময় করতে চায় অন্য গাছের সঙ্গে। জানাতে চায়, কেমন আছে। উদাহরণ টেনেছেন টিম ফ্ল্যানারি--- একটা জিরাফ যখন আকাকিয়া গাছের পাতা খেতে আসে, তখন সেই গাছ বাতাসে ছেড়ে দেয় এমন গন্ধ যা সতর্ক করে দেয় অন্য গাছদের--- সামনে বিপদ। সেই সিগনাল পেয়ে অন্য গাছেরা বের করতে থাকে টক্সিন। যা জিরাফদের একেবারেই পছন্দের নয়। একটু অন্য ধাঁচের খেলা চলে পতঙ্গদের ক্ষেত্রে। এ এক আশ্চর্য জগৎ। আমরা দেখতে পাই না, অথচ খেলা চলতেই থাকে। আর, পিটার উলহেভেন তো বলেইছেন গাছেরা শিকড়ে শিকড়ে যুক্ত হয়ে বাঁচিয়ে রাখে অন্য সুপ্রাচীন গাছ। তার শরীরে সরবরাহ করে অক্সিজেন, জল, শর্করা। মাটিকে জলের ট্যাঙ্কে পরিণত হতেও সাহায্য করে এই গাছ। আর এই গোটাটা হয় পারস্পরিক বোঝাপড়ার মধ্যে দিয়ে। যেন একে-অপরের সঙ্গে কথা বলে তারা গড়ে তোলে একটা অরণ্য।

    এমনই এক গাছ-পাগলের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল একবার দার্জিলিং যাবার পথে। সোনাদার ওপরে ওল্ড কার্ট বা ওল্ড মিলিটারি রোডের হদিশ আমায় প্রথম দিয়েছিলেন তিনি। বলেছিলেন-- দার্জিলিং যাবার ওই পুরোনো রাস্তায় এখন পরীরা আসে। গাড়ি আর চলেনা সেখানে। আর মানুষের অনুপ্রবেশ বন্ধ হওয়ায় রাস্তার পাশে নিজেদের ফের আদিমভাবে বিছোচ্ছে পুরোনো গাছের ডাল, লতা, পাহাড়ি জংলি ফুল। বলেছিলেন সোনাদা, টুং, ঘুম, দার্জিলিং-এর পাহাড় জুড়ে যে পাইন তা আসলে ধ্বংস করে দিচ্ছে এই পাহাড়। এগুলো ব্রিটিশরা জাপান থেকে এনে বসিয়েছিল উনিশ শতকে। তার আগে এই পাহাড়ের ঢেউ জুড়ে ছিল ওক, বার্চ, পূর্ব হিমালয়ের নিজস্ব আদিম গড়ন। সেইসব গাছ অন্য গাছেদের, পাহাড়ের মাটিকে বাঁচিয়ে রাখত। আর সুদৃশ্য ঐসব পর্যটকদের প্রিয় পাইন ক্রমে মেরে ফেলছে এই পাহাড়ের নিজস্ব প্রজাতিদের। ধসপ্রবণ হয়ে গেছে মাটি। চা বাগানের ঢাল দেখে মুগ্ধ হয়ে যাওয়া পর্যটকের চোখকে প্রশ্ন করা সেই মানুষটার কথাগুলো কানে বাজে—“এই পাহাড়ের আসল ল্যান্ডস্কেপটা কল্পনা করার চেষ্টা করো। চা বাগান, পাইন তা শেষ করে দিয়েছে। ঔপনিবেশিক পরিকল্পনায় গোটা পাহাড়টাকেই বদলে নিয়েছে ব্রিটিশরা। প্রাণটাই চলে গেছে যেন। জাস্ট নেই...”

    পিটার আসলে শোনাতে চেয়েছিলেন সেই বাঁচিয়ে রাখার গল্পই। বলতে চেয়েছিলেন রূপকথারা বাস্তব প্রকৃতিতেও জন্ম নেয়। যেখানে গাছ বাঁচিয়ে রাখে অন্য গাছ, জলাভূমি বাঁচিয়ে রাখে অন্য জলাশয়। আজ বিশ্ব পরিবেশ দিবস। মানুষ সেই কবে থেকে নিয়ন্ত্রণ করতে চেয়েছে প্রকৃতিকে, পুনর্নির্মাণ করতে চেয়েছে পরিবেশকে তার ইচ্ছেমতো। সভ্যতা সেই তালে গড়িয়েছে। এবং আস্তে আস্তে মানুষ বুঝতে পেরেছে এই বুড়ি পৃথিবীটাকে, তার পরিবেশকেও সে ঠেলে দিচ্ছে অমোঘ মৃত্যুর দিকে। গতি, প্রগতি--- এর সঙ্গে বিরোধাভাসে যুক্ত হচ্ছে সেই চরম শেষের আশঙ্কা। এই ভয়টা বাদেও আমাদের কান কি আর তেমন করে শব্দ শুনতে পায় পাখির, পতঙ্গের? বুঝতে পারে নদী, ডোবা, নয়ানজুলির ভাষা বা গাছেদের প্রতিক্রিয়া? পরিবেশকে কি বুঝতে ভুলে যাচ্ছি না আমরা?

    ঠিক এই কারণেই হয়ত পিটার উলেহভেনের মতো পাগলদের খুব প্রয়োজন এখন। হে পিটার, আপনিও কি জাতক গাছেদের মতো আমাদের পাহাড়কে, পাহাড়ি বনকে, আমাদের শেষ হতে বসা সব পুরোনোকে বাঁচানোর জন্য কোনও জাতকদের সন্ধান দিতে পারেন? যারা এই হুহা ধ্বংসের, অধিগ্রহণের মধ্যেও প্রাণ আগলে রাখবে। বাঁচিয়ে রাখবে।

    বঙ্গদর্শনের সপ্তাহের বাছাই করা ফিচার আপনার ইনবক্সে পেতে

    @