মিষ্টির মেদিনীপুর

মিষ্টি ছাড়া বাঙালির নববর্ষ পালন ভাবাই যায় না। তাই দোকানে দোকানে দেখা দিয়েছে হাজার রকমের মিষ্টি। পুরনো মিষ্টির সঙ্গে জায়গা করেছে চিজস, আইসক্রিম, কফি, কেকও। তবে এমনও কিছু মিষ্টি আছে, নির্দিষ্ট দোকান অথবা অঞ্চল ছাড়া যাদের আসল স্বাদ পাওয়া দুষ্কর। পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলায় বিভিন্ন রকমের মিষ্টি তৈরি হয়। বিভিন্ন জেলার মত বাংলার দক্ষিণ-পশ্চিম সীমান্তে অবস্থিত মেদিনীপুর জেলারও নিজস্ব মিষ্টি সম্ভার আছে। আগে তমলুকের ঘাট থেকে প্রতিরাতে নৌকা বোঝাই করে খোয়াক্ষীর আসত কলকাতার নতুন বাজারে।
চকলেট আইসক্রিম বাংলায় প্রভাব বিস্তার করার আগে মিষ্টি তৈরিতে ব্যবহার করা হত কৃষিজ পণ্য। বিভিন্ন জেলায় নানাস্থানে নানাপ্রকারের শস্য উৎপন্ন হত। এর ফলে এক এক জায়গায় এক এক ধরনের খাবারের উদ্ভব হয়। কৃষিপ্রধান মেদিনীপুর জেলায় তাই আগে মুগ ছোলা, চাল, গুড়, তিল দিয়ে বিভিন্ন ধরনের খাবার তৈরির প্রচলন বেশি ছিল। নাড়াজোলে প্রচুর পরিমাণে মুগডালের চাষ হয়। এখানকার মোদকরা এই মুগডাল দিয়ে একধরনের জিলাপি তৈরি করে। প্রথমে মুগডাল বেটে খামি করে নিয়ে জিলাপি আকারে ভাজা হয়। তারপর রসে ভেজাতে হবে। কথিত আছে, নাড়াজোলের রাজবাড়িতে কোনো অতিথি আসলে এই মুগ ডালের জিলাপি দিয়েই প্রথমে মিষ্টিমুখ করা হত।
আরও পড়ুন
কমলাভোগের কাহিনী কান্ডারি
মেদিনীপুরের দাসপুর থানার চাঁইপাটের তৈরি বাতাসা এক একটি থালার মত। এখানে বারোয়ারি দুর্গা বা কালীপুজার সময় বাতাসা দড়িতে বেঁধে প্রতিমার পাশে ঝুলিয়ে রাখা হত। এই বাতাসা আকারে বড় হলেও ওজনে খুব হালকা হয়। কদমা তৈরি হয় ফুটবলের মত। ক্ষীরপাইয়ের ‘বাবরশা’ বিখাত মিষ্টি। এই অঞ্চলের রেশমকুঠির রেসিডেন্ট এডওয়ার্ড বাবরের নামে পরান আটা নামে এক কারিগর এই মিষ্টি তৈরি করেছিলেন। এছাড়া এখানকার বিখ্যাত মিষ্টিগুলি হল গোলালুর পিঠা, নারকেলকুড়ো ও ময়দা মিশিয়ে তৈরি করা আলি, হুডুমভাজা, আলার মিছরি।
বেসন, সুজি, চিনি, ময়দা দিয়ে চন্দ্রকোনায় তৈরি হয় চাঁদশাহী খাজা, বুটের মিষ্টি, মালপোয়া, শ্রীপাট ও গোপীবল্লভপুরে সুজি ও চিনি দিয়ে তৈরি করা হয় মগদনাড়ু, লালগড় ও রামগড়ের ঝুরিভাজা ও গুড় মেশানো মিষ্টি, চেতুয়া-বৈকুণ্ঠপুরে আটা, সুজি ও চিনি দিয়ে তৈরি করা হয় পন্ঝুরি, নারায়ণগড়ের বাদশাভোগ ধানের খইএর মুড়কি, দাসপুর থানার সরবেড়ের চিনিপাতা দই, গড়বেতার মহিষের দুধের জমাট ঘৃতবহুল দই, চুনাদই এখানকার প্রসিদ্ধ মিষ্টি। মেদিনীপুরের আরেকটি বিখ্যাত মিষ্টি হল ক্ষীরের গজা। এর আকার অনেকটা কলকাতার চিত্রকূটের মতো হলেও, ক্ষীরের ভাগ খুব কম। গজাটি ভাজার পর রসে ভিজিয়ে নরম করা হয়। কাঁথির কাজুবাদামের সন্দেশ ও নারকেল রসের সাদাগুড় মিষ্টির খুব খ্যাতি। কথিত আছে, কাজুবাদামের সন্দেশ নাকি জওহরলাল নেহেরু-র খুব প্রিয় ছিল। খাঁটি দুধে অল্প পরিমাণে সরু চাল তার সঙ্গে কিসমিস, কাঠবাদাম, পেস্তা, এলাচগুঁড়ো, মিছরিগুঁড়ো বা চিনি মিশিয়ে একধরনের সুস্বাদু পায়েস তৈরি করা হয়। একে বলে তস্মৈ।
(তথ্যসূত্র- বাংলার খাবার / প্রণব রায়)