No Image

   

00:00
00:00
Volume

 0 Songs

    জিরো মাইলের ফলক

    জিরো মাইলের ফলক

    Story image

    কলকাতার মানুষ চিরকালই ‘হা’ বলতে ‘হাওড়া’ বোঝে। আর নয়ই বা কেন? ভ্রমণ থেকে শুরু করে বাণিজ্য অথবা কৃষিবঙ্গের মানচিত্রের সিংহদুয়ার কিংবা কল-কারখানার হাত ধরে গড়ে উঠা বাংলা মুলুকের ইন্ডাস্ট্রিয়াল রেভোলিউশন সবেরই সুলুক ঠিকানা ওই হাওড়াই। সেই সঙ্গে সাংস্কৃতিক মানচিত্রেও কলকাতা ও হাওড়ার যোগসূত্র এমনই যে, সেদিন থেকে আজ পর্যন্ত কলকাতার পশ্চিম বলতে মানুষ হাওড়াকেই বোঝে। এমনই কলকাতার হাওড়া সেতুর ওপারে যে স্টেশন চত্বর সেখানেই সবার অলক্ষ্যে পড়ে রয়েছে একটি ‘মাইল ফলক’। ফলকটি লাগিয়েছিল ইস্ট-ইন্ডিয়া রেল কোম্পানি। না কোন পাঁচ মাইল, দশ মাইল লেখা নেই এতে। শুধু গোটা গোটা ইংরেজি অক্ষরে লেখা আছে ‘ORIGINAL ZERO MILE’। সেই লেখার ঠিক নিচে সূর্যের চক্রের মত একটা গোলক, চেহারায় চরিত্রে যেন একটি সিলিং ফ্যান। আসলে এটি একটি জিরো মাইলের ফলক। শূন্য থেকে শুরু শব্দটার গুরুত্ব ভূগোলবিদরা জানেন। এরকমই একটি শূন্য থেকে শুরুর ফলক হল এই জিরো মাইল ফলকটি। চোখে দেখার উপায় নেই। কারণ হাওড়ার বারো-তেরো নম্বর প্ল্যাটফর্মের মাঝখানে শয়ে শয়ে পার্সেলের বাক্স আর বস্তায় তা ঢাকা পরে গিয়েছে। তাছাড়া ওই রাস্তায় সাধারণ মানুষের প্রবেশও নিষেধ। যদিও রেলদপ্তরের মহাফেজ খানায় ফলকটির একটি সিপিয়া প্রিন্ট ছবি যত্ন করে রাখা আছে। দপ্তর প্রকাশিত নথিতেও তার উল্লেখ আছে। কিন্তু কথা হল শূন্য ফলকের গুরুত্ব কোথায়? বুঝতে গেলে আমাদের ফিরে যেতে হবে রেল চলাচলের গোড়ার কথায়।

    মহারাণীর ব্রিটেন দেশে রেলপথ খোলার আঠাশ থেকে তিরিশ বছর পরের কথা। ভারতবর্ষে রেলচালু হল সন ১৮৫৩ আর তারিখ ১৬ এপ্রিল। সে যাত্রায় রেল চলেছিল- বোম্বে থেকে থানে পর্যন্ত। তার ঠিক একটি বছর পর বাংলা মুলুকে কল চালিত রেলগাড়ির আগমন। ইস্ট-ইন্ডিয়া রেলওয়ে কোম্পানি রেল খুললো ১৮৫৪ –র ১১ আগস্ট। সেই ট্রায়াল রানের দিন গাড়ি চললো চুঁচুড়া অবধি। তুমুল হৈ চৈ। সময় সারণিটি দেখলে বোঝা যায় মোট তিপ্পান্ন মিনিট সময় লেগেছিল তেইশের কিছু বেশি মাইল রাস্তা যেতে। হাওড়া থেকে গাড়ি ছাড়লো সকাল সাড়ে আটটায়। বালি স্টেশন মানে সাড়ে পাঁচ মাইল পথ যেতে গাড়ির লাগলো এগারো মিনিট।এর পর শ্রীরামপুর মানে ছয়ের একের চার মাইল যেতে গাড়ি সময় নিল চোদ্দো মিনিট। সেখান থেকে চন্দননগর মানে পরবর্তী আরও সাড়ে আট মাইল পৌঁছতে গাড়ির সময় লাগলো কুড়ি মিনিট। তার পর হুগলী মানে চুঁচুড়ায় পরবর্তী তিন মাইল যেতে গাড়ি সময় নিল আরও আট মিনিট। এই ভাবে মোট তেইশের একের চার মাইল পৌঁছতে গাড়ি ওই তিপ্পান্ন মিনিট সময় নিয়েছিল। অক্ষাংশ দ্রাঘিমাংশ মেপে গাড়ি যে এই মাইলের পর মাইল যাবে তার জন্যে তো শূন্য মাইলের হিসাবটাও থাকা দরকার। না হলে তো দূরত্ব বোঝা ভার। তাছাড়া শূন্য মাইলের হিসাব না করে কিভাবেই বা রেল মানচিত্র করা সম্ভব? বিশেষ করে বাংলা যখন ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানির দ্বিতীয় বসতবাটি তথা বঙ্গের কলকাতায় তার রাজধানী।

    তাই ত্রিকোণমিতির হিসাব মাপা শুরু হল। সেই হিসাব করে দেখা গেল বর্তমান হাওড়া স্টেশন চত্বরটি মূলত শূন্য মাইলের একটা হদিস দেয়, যেখান থেকে শুরু। সেই মাপ জোকের পর সেখানে বসলো একটি ফলক। কিন্তু সেই ফলকের আড়ালে আবডালে লুকিয়ে রইলো বঙ্গে রাজ কোম্পানির অন্য আর একটি অভিলাষ। যেমন যে চত্বর অবধি রেলগাড়ি প্রথম চললো সেই সব চত্বর ছিল মূলত ডাচ বা ফরাসিদের তাবে। বহুদিন ধরেই সেই মানচিত্রে নিজের দখল ও অস্তিত্ব প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছে ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানি। কোনও যুদ্ধে না গিয়ে সেখান দিয়ে সরাসরি রেল চালিয়ে দিল তারা। এমন আধুনিকতায় বাধ সাধবে কে। তাই মেনে নেওয়াই কাজের কথা। বাঙালিও অকপটে জমি দিতে লাগলো রেলপথের জন্য। বড় লোকেদের কেউ কিনলেন শেয়ার, কেউবা আবার নেমে পড়লেন কোম্পানির সহযোগী হয়ে নতুন রেলপথ খুলতে। ইংরেজের উদ্দেশ্য ছিল শাসনব্যবস্থার সুবিধা আর অন্যদিকে বাঙালি তখন নয়া লক্ষ্মী লাভের পথ খুঁজে নিতে চলেছে। রেলপথ খোলার কাজে এগিয়ে এসেছিলেন দ্বারকানাথ ঠাকুরও। তিনি রানীগঞ্জ পর্যন্ত রেলপথের কথা ভেবেছিলেন। এই ভাবেই দেখা গেল বাদশাহি সড়ক মানে শেরশাহের জি.টি রোডের সমান্তরালে এগিয়ে যেতে থাকলো রেলপথ, হাওড়া মুলুকের শূন্য মাইল ফলক থেকে বাকী মাইল সংখ্যা মেপে। বাদশাহি পথে তখন অহরহ চলে লুটপাট। তাই বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবেও খোলা হল রেলপথ। দেখা গেল পান্ডুয়া রানীগঞ্জ ছাড়াও রেললাইন ছড়িয়ে পড়ছে মোগলসরাই সীতারামপুর মুরাদাবাদ কিউল কাশী লক্ষ্মৌ এবং দিল্লী। শূন্য ফলক থেকে মাইলের পর মাইল ছুটলো গাড়ি কিন্তু জিরো মাইলের হিসেব রইলো হাওড়াতেই।

    সেদিন বাঙালির সঙ্গে রেলপথের ও রেল কোম্পানির সম্পর্ক ভারি মধুর। চালু হল অনেক গল্প। যেমন- একটি গল্প শোনালেন সুকুমার সেন। তিনি বলছেন-“বাবু রামগোপাল ঘোষ তখনকার দিনের বাঙালী সমাজে একজন প্রধান ব্যক্তি ছিলেন। তিনি ইস্ট ইণ্ডিয়ান রেলওয়ে কোম্পানির শেয়ার কিনেছিলেন। সেই কারণে রেলরাস্তায় তাঁর অসাধারণ খাতির ছিল। তাঁর বাড়ি ছিল পাণ্ডুয়া ও মগরার মাঝামাঝি এক গ্রামে। পাণ্ডুয়া পর্যন্ত ট্রেন চলাচল শুরু হবার পর রামগোপালবাবু প্রায়ই সপ্তাহান্তিকে দেশে যেতেন। তাঁর যাতায়াতের সময় ড্রাইভার ও গার্ড তাঁর ওপর নজর রাখত। একদিন দেশ থেকে তাঁর ফেরবার কথা। তিনি গাড়ি চড়েছেন কি চড়েছেন তা না জেনেই গার্ড হুইসিল দেয়। গাড়ি চলতে শুরু করে। কিছুদূর গিয়ে গার্ড বা ড্রাইভার লক্ষ্য করলে রামগোপালবাবুর পালকি ছুটে আসছে। অমনি গাড়ি থামিয়ে দেওয়া হল। রামগোপালবাবু চড়লে পর গাড়ি ছাড়ল। এ খাতির তো সামান্য নয়।”

    সেদিন ফরাসি ডাচ বা দিনেমারদের পাড়ায় রেল ঢুকিয়ে দিল ইংরেজ। সেদিন রেলপথ চালু হল বলেই গঙ্গা নদীকে বাদ দিয়ে ব্যবসা ছড়ানোর পথ খুঁজে নিল ইংরেজ। সেই কারণে রাজধানীও বদল হয়ে গিয়েছিল কলকাতায়। মুর্শিদাবাদ হারিয়েছিল তার বাদশাহি গরিমা। সেদিন রেলপথ পাতার মানে ছিল সাম্রাজ্যবাদের রেখা বিস্তার। রেলপথের মানে ছিল দেশের ভেতরের সমস্ত রাজ্যের সীমানাকে রেল সুতোয় ঘিরে ধরা। অন্যদিকে বাঙালিও তাঁর বাণিজ্যের স্বপ্নকে ঘর হতে দুই পা ফেলে আরও অনেক দূরে পৌঁছে দিতে চাইল। ঘর কুনো থাকলো না কেউ। শূন্য মাইলে বসে থাকলে হবে না, এগিয়ে যেতে হবে আরও অনেক অনেক পথ। শুধু কতটা পথ যাওয়া হল সেটা মেপে নেওয়ার জন্য রোজই শূন্য মাইল ফলকের কাছে ফিরে আসাটা অবশ্যই জরুরি। সেদিনের সেই রেওয়াজ রুটিনের ইতিহাস গায়ে মেখে আজও দাঁড়িয়ে আছে ফলকটি। মাইলের দিন গিয়েছে ঠিকই কিন্তু শুরুর দিনের ইতিহাসটি তার গরিমা বা অহমিকার বা স্বপ্ন বোনার হাতছানির রহস্যটিকে হারায়নি।   

    তথ্যসূত্র- রেলের পা-চালি, সুকুমার সেন।
    পূর্ব রেলওয়ে প্রকাশিত স্মারকগ্রন্থ,
    কৃতজ্ঞতা স্বীকার- প্রদোষ চৌধুরী, পূর্ব-রেল

    Tags:

    বঙ্গদর্শনের সপ্তাহের বাছাই করা ফিচার আপনার ইনবক্সে পেতে

    @