No Image

   

00:00
00:00
Volume

 0 Songs

    ট্রেনের রাজা ও বাঙালি অনুরাগীর গপ্প  

    ট্রেনের রাজা ও বাঙালি অনুরাগীর গপ্প  

    Story image

    একটা নিয়মমাফিক ঘোষণা। ৩ নম্বর প্ল্যাটফর্ম দিয়ে রাজধানী এক্সপ্রেস যাবে। নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়ানো মানুষগুলির চোখের সামনে দিয়ে শোঁ করে চলে গেল ট্রেন। বেশ খানিকটা ধুলো একজোট হয়ে গোল গোল ঘুরতে ঘুরতে ধাওয়া করল ট্রেনকে। আর ধাওয়া করল একরাশ মুগ্ধ চোখ। প্ল্যাটফর্মের অভ্যস্ত দোকানিরাও না তাকিয়ে পারে না এই ট্রেনের দিকে। বড়ো রাজকীয় তার যাওয়া। ভারতের লজঝরে রেল। তারই মধ্যে এখনো এমন মুগ্ধতারা বেঁচে থাকে একটি ট্রেনকে ঘিরে। রাজধানী এক্সপ্রেস—যে ট্রেনের সঙ্গে বাঙালির সম্পর্ক জন্মলগ্ন থেকেই।

    আজ থেকে ঠিক পঞ্চাশ বছর আগে, ৩ মার্চ হাওড়া থেকে দিল্লির দিকে ছুট লাগাল ভারতবর্ষের প্রথম রাজধানী এক্সপ্রেস। প্রথম দিন থেকেই সে ভারতীয় রেলপথের রাজা। ঘণ্টায় ১২০ কিমি বেগে ছোটে! ১৯৮৮ সালে নিউ দিল্লি-ভোপাল শতাব্দী এক্সপ্রেস চালু হওয়ার আগে অবধি গতিতে তার সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার সাধ্য ছিল না কোনো ট্রেনের। শুধু কি গতি! চালচলনে, সজ্জায় আভিজাত্য চুঁইয়ে পড়ত এই ট্রেনের। রাজকীয় যাত্রার স্বাদ পেতে গেলে রাজধানীর কোনো তুলনা হয় না—একবাক্যে স্বীকার করতেন সকলেই। কেষ্টু-বিষ্টু, সেলিব্রিটি, তাবড়-তাবড় সব লোকজন এই ট্রেনের বাঁধা যাত্রী। তাছাড়া, ভারতীয় রেলে রাজধানী এক্সপ্রেসের মতো গুরুত্বও পেত না অন্য কোনো ট্রেন। সেটাই তো স্বাভাবিক!

    নিউ দিল্লি-হাওড়া রাজধানীর আভিজাত্য আজো অটুট

    আর এমন রাজকীয় রাজধানী এক্সপ্রেসের প্রথম গ্রিন সিগনাল প্রাপ্তির সঙ্গেই জড়িয়ে আছে হাওড়া স্টেশন। এরপর, ক্রমে ভারতবর্ষের অনেকগুলি শহর থেকেই চালু হবে একাধিক রাজধানী এক্সপ্রেস। এক এক করে মোট ২৫ জোড়া রাজধানী চলাচল করবে ভারতের রেলপথে। সময়ের সঙ্গে নানা বদল হবে ট্রেনের চেহারায়, গতিবেগেও। কিন্তু, রাজধানী এক্সপ্রেসের সঙ্গে হাওড়া স্টেশনের পুরোনো সম্পর্কটিতে চিড় ধরবে না। যেমন কাটবে না, তাকে ঘিরে বাঙালি রেলযাত্রীদের মুগ্ধতাও। যা চলে যায়, তা নিয়েই স্মৃতির উল বোনা বাঙালির অভ্যেস। সেই নস্টালজিয়া থেকে বর্তমান স্টেশনের দূরপাল্লার পথে এখনো পাড়ি জমাচ্ছে রাজধানী।

    এহেন রাজকীয় ট্রেনের পথচলা তো হঠাৎ করে শুরু হতে পারে না। তাই, সাতবছর ধরে বিস্তর গবেষণা, পরীক্ষা-নিরীক্ষা, চিন্তাভাবনার পরেই সবুজ সংকেত পেল রাজধানী এক্সপ্রেস। এত্তগুলো বছর লাগল কেন? লাগবে না! এর আগে ভারতীয় রেলের একশো বছরের ইতিহাসে কোনো ট্রেনই ঘণ্টায় ১০০ কিমি গতিবেগের সীমা ছাড়াতে পারেনি। সর্বোচ্চ গতি ছিল ঘণ্টায় ৯০ কিমি। সেখানে রাজধানী দৌড়বে ১২০ কিমি বেগে। তারওপর, এই ট্রেনের গোটাটাই বাতানুকুল। অভিজাত এবং ধনী না হলে এই ট্রেনের যাত্রী হওয়া অসম্ভব। ফলে, যাত্রীর অভাবে ট্রেন বিপুল ক্ষতিপূরণের মুখে পড়বে কিনা, সেটা নিয়েও যথেষ্ট আশঙ্কা ছিল। সবচাইতে বেশি ছিল প্রয়োজন পরিকাঠামো নিশ্চিত করা। এমন রাজকীয় ট্রেন, অভিজাত সব যাত্রী, ট্রেনের পরিকাঠামো গণ্ডগোল করলেই সর্বনাশ। অতএব সবদিক নিখুঁত হওয়ার পরেই দৌড়বার ছাড়পত্র পেয়েছিল রাজধানী।

    প্রথম রাজধানী এক্সপ্রেস এবং তার চালক জি এল টচার ও গার্ড এস ও লেভি

    হাওড়া স্টেশন থেকে রওনা দেওয়া প্রথম রাজধানী এক্সপ্রেসের চালক ছিলেন জি এল টচার। তাঁকে ট্রেন ছাড়ার সবুজ সঙ্কেত দিয়েছিলেন গার্ড এস ও লেভি। সেই রাজধানীতে কোচ ছিল ন’টি। দুটি লাউঞ্জ কার, পাঁচটি চেয়ার কার, একটি  ডাইনিং কার এবং একটি ফার্স্ট ক্লাস। এরপর, ১৪৪৫ কিলোমিটার পথ মাত্র ১৭ ঘণ্টা ২০ মিনিটে পেরিয়েছিল সে। দাঁড়িয়েছিল ধানবাদ, গয়া, মুঘলসরাই, ইলাহাবাদ, কানপুর স্টেশনে। এতটা যাত্রাপথে মাত্র পাঁচটা স্টেশন। রাজধানী এক্সপ্রেস বলে কথা! তার ব্যাপারই আলাদা।

    শুরু থেকেই এই ট্রেনকে ঘিরে জমা হতে আরম্ভ করল বিস্ময়। সে যে কেউকেটা, তা নিয়ে আর সন্দেহ রইল না। বিশেষ কিছু বোঝাতে রাজধানী এক্সপ্রেসের উপমা ব্যবহার শুরু হল। তখন এই ট্রেনের বাতানুকুল প্রথম শ্রেণির ভাড়া ছিল ২৮০ টাকা আর চেয়ার কারের ভাড়া ৯০ টাকা। সেইযুগের বিচারে মহার্ঘ। সাধারণ মধ্যবিত্তের নাগালের বাইরে। তার ওপর, টিকিট পাওয়া যেত কেবলমাত্র ‘এন্ড টু এন্ড’ ভিত্তিতে। মাঝপথে নামলে তার আলাদা টিকিট পাওয়া যেত না। খাবার সরবরাহ করা হত ট্রেনের ভিতরেই। প্যান্ট্রি থেকে চা-কফি আনিয়ে লাউঞ্জ কারের সোফায় বসে দিব্বি পড়া যেত খবরের কাগজ, ম্যাগাজিন। এই লাউঞ্জ কার অবশ্য আর নেই। যেমন নেই ডাইনিং কার।

    এমন নয়, সম্পূর্ণ বাতানুকুল রাজকীয় ট্রেন এর আগে দেখেনি বাংলার মানুষ। হাওড়া-নয়াদিল্লির মধ্যে ‘এয়ারকন্ডিশনড ডিলাক্স এক্সপ্রেস’-এর যাত্রা শুরু হয়েছিল রাজধানীর আগেই। এই ট্রেনেও ছিল ডাইনিং কার, লাউঞ্জ। সত্যজিৎ রায়ের ‘নায়ক’-এর ট্রেনের দৃশ্যগুলি এই ট্রেনেরই। কিন্তু, তা সত্ত্বেও রাজধানী রাজা। গতিতে, আভিজাত্যে, যাত্রী স্বাচ্ছন্দ্যের বিচারে সে চিরকালই এগিয়ে। রাজধানীর টিকিটও ছিল আলাদা। দেখবার মতো। দু’পাশে মোটা কাগজ কাগজের ফ্ল্যাপ। প্রচ্ছদে কুতুব মিনার আর হাওড়া ব্রিজের ছবি। যেদিকে ট্রেন যাবে, সেদিকে তিরের অভিমুখ। 

    সময়ের সঙ্গে সঙ্গে চেহারায় অনেকটাই বদল এল রাজধানী এক্সপ্রেসের। চেয়ার কার উঠে গেল। ১৯৮৩ আর ১৯৯৩-তে ক্রমান্বয়ে যুক্ত হল টু-টিয়ার আর থ্রি-টিয়ার। উদ্দেশ্য স্পষ্ট, বিত্তবানদের পাশাপাশি উচ্চ মধ্যবিত্ত যাত্রীদেরও টেনে আনা। তখন পুজো বা গরমের লম্বা ছুটিতে যাত্রীদের আকর্ষণের জন্য বিজ্ঞাপন দিত রেল। একমাত্র রাজধানী এক্সপ্রেসের জন্যেই আলাদা করে বিজ্ঞাপন তৈরি হয়েছিল। পূর্ব রেলওয়ের দেওয়া সেই বিজ্ঞাপনে ছিল একটা পক্ষীরাজ ঘোড়ার ছবি। এই ট্রেন যেন সেই ঘোড়ার মতোই উড়িয়ে নিয়ে যাবে সকলকে। হাওড়া থেকে ট্রেন সপ্তাহে দু’বার—সোম আর শুক্র। বিজ্ঞাপনে স্পষ্ট করে লেখা-- ‘ভ্রমণ হবে আরামদায়ক, বিলাসবহুল এবং ধুলোবালিমুক্ত।’ সঙ্গে ‘চমৎকার আহার্য’-র হদিশ দিয়ে লেখা- ‘সন্ধ্যার চা, রাতের খাবার ও প্রাতঃরাশ— পৌঁছে দেবার ব্যবস্থা আছে।’ রাজধানীর খাবারও নাকি ছিল অনবদ্য। এখনো পুরোনো যাত্রীদের মধ্যে অনেকেই সেই নরম স্যান্ডুইচ, কারির স্বাদমেদুরতায় আচ্ছন্ন হন।

    পূর্ব রেলের সেই বিজ্ঞাপন

    উচ্চ মধ্যবিত্তদের কথা ভেবে টু-টিয়ার আর থ্রি-টিয়ারের টিকিটমূল্য ধার্য করেছিল রেল। রাজধানীর রাজকীয় আরামের যাত্রার আকর্ষণ এড়াতে না পেরে হুহু করে বাড়তে লাগল সেই টিকিটের চাহিদা। চাহিদা বাড়তে বাড়তে এমন জায়গায় পৌঁছল যে রেল বাধ্য হল শিয়ালদা থেকেও একটি রাজধানী এক্সপ্রেস চালানোর সিদ্ধান্ত নিতে। যাত্রীসংখ্যা বাড়ার কারণে বহরেও বাড়ল ট্রেন। আদলটিও গেল বদলে। ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে ‘সোয়ার্ন’ স্ট্যান্ডার্ডের এলএইচবি কোচ ব্যবহার শুরু হল। এখন রাজধানীতে থাকে মোট ২০টি এলএইচবি কোচ। দুটি প্রথম শ্রেণি, পাঁচটি দ্বিতীয় শ্রেণি, দশটি তৃতীয় শ্রেণি। সঙ্গে প্যান্ট্রি। অতীতের লাউঞ্জ ও ডাইনিং কার এখন নস্টালজিয়ার সম্পত্তি। 

    অতীতের অনেক কিছুই হারিয়েছে রাজধানী এক্সপ্রেস। এখন সে তুলনায় অনেক বেশি সাধারণের আয়ত্তের মধ্যে। রাজা সাধারণের কাছাকাছি নেমে এলে সাম্যের আকাঙ্ক্ষা করা মানুষদেরও অদৃশ্য জিনে কেমন মোচড় লাগে। এ এক অসুখ যেন। তাই, রাজধানীকে নিয়েও ‘গেল গেল’ রব ওঠে আজকাল। হয়তো ঠিক কারণেই ওঠে। তবু, নতজানু মুগ্ধতারা মরে না। এখনো সে ছুট লাগালে চোখ ধাওয়া করে তাকে। অন্য ট্রেন অপেক্ষা করে নিজের জায়গা ছেড়ে দিয়ে। সে যে রাজধানী এক্সপ্রেস। ট্রেনের রাজা।
    এত সহজে এ রাজত্ব যাওয়ার নয় তার।    

    বঙ্গদর্শনের সপ্তাহের বাছাই করা ফিচার আপনার ইনবক্সে পেতে

    @