No Image

   

00:00
00:00
Volume

 0 Songs

    এ শহরের চার-চাকার একমাত্র ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডর

    এ শহরের চার-চাকার একমাত্র ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডর

    Story image

    “আপনাদের সেই লম্বা মানুষটিকে আজ তাঁর গাড়ি থেকে নামতে দেখলাম।
    নামছেন তো নামছেন তো নামছেন তিনি!”

    নিজের অ্যাম্বাসাডর থেকে সত্যজিৎ রায়কে একবার নামতে দেখেছিলেন কমলকুমার মজুমদার। তারপর বন্ধুদের কাছে এই ঐতিহাসিক বর্ণনা। দীর্ঘাকৃতি সত্যজিৎ রায় যেন একটি ময়াল সাপ। তাঁর নামা শেষই হয় না গাড়ি থেকে। 

    অতিরঞ্জন যতই থাক, ছ’ফুটের ওপর লম্বা সত্যজিৎ রায় সত্যি সত্যিই বসতেন গাড়ির সামনে। ড্রাইভারের পাশের সিটে। অ্যাম্বাসাডরের সামনে অনেকখানি জায়গা, পা মেলতে সুবিধে হত তাঁর। তবে, অ্যাম্বাসাডরের সামনেই যে শুধু বেশি জায়গা, তা বলি কেমন করে? ‘জন অরণ্য’-র শ্যুটিং-এ গোটা সত্যজিৎকে গিলে নিয়েছিল অ্যাম্বাসাডরের পিছনের ডিকিও! আজ্ঞে, সত্যি ঘটনা। শ্যুটিং-এর জন্য অ্যাম্বাসাডরের পিছনের ডিকিটি খুলতে ফেলতে বলেছিলেন সত্যজিৎ। তারপর সেই উন্মুক্ত গহ্বরে ঢুকে গেলেন নিজে, পা-ভাঁজ করে। তারপরে ডিকিতে তুলে নিলেন ‘অ্যারিফ্লেক্স’ ক্যামেরাটাও। এমনই মস্ত সে ডিকি, তারপরেও দেখা গেল খানিক জায়গা বেঁচে আছে! অ্যাম্বাসাডর এমনই গাড়ি!

    এ অবশ্য আমাদের পরিচিত দৃশ্য। বিয়েবাড়ির তত্ত্ব থেকে বাড়িবদলের বাক্স-প্যাঁটরা—দড়ি দিয়ে বেঁধে সব তুলে দেওয়া হত অ্যাম্বাসাডরের ডিকিতে। ধরেও যেত সব। জায়গা অকুলান হত না।

    অ্যাম্বাসাডরকে ঘিরে এমনই কত্ত সব গল্প এ শহরের। বিশেষ করে আমাদের পূর্বপ্রজন্মের মানুষদের। এই শহরের বনেদিয়ানা, আভিজাত্য, পরিশ্রম—সব কিছুর সঙ্গে তাল রেখে ঘুরেছে এই গাড়ির চাকা আর স্টিয়ারিং। শুধু কলকাতা বলি কেন? গোটা ভারতের প্রধানমন্ত্রী, রাষ্ট্রপতি সহ তাবড়-তাবড় নেতা-মন্ত্রী-কেউকেটারা চড়ে বেড়িয়েছেন এই গাড়িতে। রাস্তায় সাদা অ্যাম্বাসাডর মানেই যেন গণমান্য কেউ চলেছেন। অবশ্য, সেইসব বিগত দিনের গপ্প। তখনো পৃথিবী এতটা উত্তপ্ত হয়নি। গোটা দেশেই গাছপালা ছিল বেশি, শহরে ফ্ল্যাট-উড়ালপুল গজায়নি, ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ, টুইটারের কথা শোনেইনি কেউ। তখন অ্যাম্বাসাডর বলতেই হলুদ ট্যাক্সি বুঝত না শহরবাসী। অ্যাম্বাসাডর তখন প্রকৃতপক্ষেই এই দেশের চারচাকা-জগতের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডর। 

    সত্যি সত্যি একদিন চারচাকায় দেশ-শাসন করেছে এই গাড়ি। আর ভারতবিজয়ের জন্য তাকে গড়ে-পিটে তৈরি করা হয়েছে এই রাজ্যের হাওড়া জেলার হিন্দুস্থান মোটরস-এর একটা বিশাল কারখানা থেকে। এখন যে অঞ্চলের নামই হিন্দমোটর। অর্থাৎ, জন্মলগ্ন থেকেই ঘোরতর বঙ্গবাসী এই গাড়ি। ফলে, তাকে ঘিরে বাঙালিদের স্মৃতিমেদুর আবেগও কিঞ্চিৎ বেশি। 

    ১৯৫৮ সালে বিড়লা কোম্পানির হিন্দুস্থান মোটরস-এর কারখানা প্রসব করল প্রথম অ্যাম্বাসাডর। ইংল্যান্ডের মরিস মোটরস লিমিটেডের অক্সফোর্ড ৩ সিরিজের আদলে তৈরি হলেও এই গাড়ি আপাদমস্তক স্বদেশি। জনপ্রিয়তার তুঙ্গে উঠতে একদমই বেশি সময় নেয়নি তৎকালীন ভারতীয় চার-চাকা গাড়ির জগতের রাষ্ট্রদূত ‘অ্যাম্বাসাডর’ ওরফে ‘অ্যাম্বি’। বিশেষ করে বিত্তবানদের মধ্যে এই গাড়ি নিয়ে হইচই পড়ে গেল। শক্তপোক্ত চেহারা, অনেকটা দূর একটানা দৌড়তে পারার মতো শক্তিশালী ইঞ্জিন, ৫৪ লিটার তেলের ট্যাঙ্ক আর কোন গাড়িতে মেলে? চারজনের জায়গায় অনায়াসে গাড়িতে ঢুকে যেতে পারে পাঁচ-ছ’জন। আর, গাম্ভীর্য বটে গাড়ির। রাস্তা দিয়ে যখন চলে, আভিজাত্য চুঁইয়ে পড়ে যেন।

    এমন নয় দেশের বিত্তবানদের জন্য এর চাইতে দামি গাড়ি ছিল না তখন। অস্টিন, স্টুডিবেকার, মরিসের মতো শৌখিন, দামি গাড়িরা দিব্বি ছিল। কিন্তু, তারপরেও অ্যাম্বাসাডর নিজের জায়গা করে নিল দ্রুত। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আদরের অ্যাম্বাসাডরের রূপান্তরেও কোনো ত্রুটি রাখেনি বিড়লারা। ১৯৫৮-তে অ্যাম্বাসাডরের প্রথম মডেল মার্ক ১ বেরোনোর পাঁচবছরের মধ্যেই ১৯৬৩-তে বেরোল মার্ক ২। তখনো অবধি অ্যাম্বাসাডর মানেই সাদা আর কালো। মার্ক ২ মডেলের প্রথম কালো রঙের গাড়িটি বিড়লারা উপহার দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুকে। 

    এরপর, অবশ্য সাদা-কালোর দুনিয়া ছেড়ে ক্রমশ রঙিন হতে শুরু করে অ্যাম্বাসাডর। নীল, সবুজ রঙের অ্যাম্বাসাডরও চোখে পড়ত রাস্তায়। মার্ক ৩, মার্ক ৪ বেরোলো একে একে। ভারতের প্রথম ডিজেল গাড়ি হিসেবেও ইতিহাসে নাম লেখাল অ্যাম্বাসাডর। তখন তার ব্যাপারই আলাদা। নেতা-মন্ত্রী মানেই সাদা আম্বাসাডর। সামনে জাতীয় পতাকা। তাছাড়া, কলকাতায় বড়ো বড়ো হোটেলের সামনেও পার্ক করা থাকে সাদা রঙের এই রাজকীয় গাড়ি। উল্টোদিকে কালো অ্যাম্বাসাডর যেন খানিক ডার্ক নেচারের। সত্যজিৎ রায়ের ‘সোনার কেল্লায়’ ডা. হাজরার গাড়ির মতো। যদিও, গাড়ির রঙের সঙ্গে গাড়ি-মালিকের চরিত্রের এমন সহজ সমীকরণ মিলত না বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই। এই যেমন সন্তোষকুমার ঘোষেরই নাকি ছিল কালো রঙের অ্যাম্বাসাডর। মনে পড়ে গেল, ‘ছদ্মবেশী’ সিনেমায় বিকাশ রায়ের কালোরঙের অ্যাম্বাসাডরেরই ড্রাইভার সেজেছিলেন উত্তমকুমার।

    তবে, অন্য রঙের অ্যাম্বাসাডরের বাজারও বাড়ছিল ক্রমশ। নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর যেমন ছিল ধূসর মডেলের গাড়ি। নীল রঙের অ্যাম্বাসাডরের দেখাও মিলেছিল ‘সোনার কেল্লায়’। মনে পড়ে সিংজির নীল রঙের গাড়িতে চেপেই জয়সলমিরের উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছিল মেলুদা-তোপসে আর লালমোহনবাবু। রাস্তায় সেই গাড়িরই টায়ার পাংচার। তবে, সবুজ রঙের অ্যাম্বাসাডর সচরাচর কেউ কিনতেন না লালমোহনবাবু ওরফে জটায়ুর মতো মানুষ না হলে। ‘গোরস্থানে সাবধান’ গল্পের শুরুতেই উৎকট সারেগামা হর্ন বাজিয়ে সেকেন্ড হ্যান্ড মার্ক টু অ্যাম্বাসাডর নিয়ে ফেলু মিত্তিরের বাড়িতে এসেছেন লালমোহনবাবু। গাড়ির রং দেখে ফেলুদার উক্তি ‘রংটাও ইকুয়্যালি পীড়াদায়ক। মাদ্রাজি ফিল্মমার্কা।’ বোঝাই যায়, এই রঙের অ্যাম্বাসাডরকে মোটেই সাদরে গ্রহণ করেননি শিক্ষিত-রুচিশীল এবং অভিজাত বাঙালিকুল।

    তা বলে, অ্যাম্বাসাডরের থেকে মুখ ঘুরিয়ে নেয়নি কেউ। আশির দশক অবধি চুটিয়ে রাজত্ব করেছে এই গাড়ি। গোটা দেশে আর বিশেষ করে বাংলায়, এই শহরে। বাংলা সিনেমা জুড়েও অ্যাম্বাসাডর। সে হাজির চরিত্রদের ওজন বোঝাতে, প্রেমদৃশ্যকে জায়গা করে দিতেও। অ্যাম্বাসাডরের ভিতরেই প্রেমের দৃশ্য বুনেছেন উত্তম-সুচিত্রা, সৌমিত্র-অপর্ণা সহ অনেকেই। একটাই গাড়ি একইসঙ্গে হয়ে উঠেছিল মধ্যবিত্তদের আর্থিক বৈভব, অহংকারের প্রতিরূপ এবং রোমান্সের নিশ্চিন্ত আশ্রয়। এমন গাড়িকে ঘিরে প্রেম জন্মাবে না তো কাকে ঘিরে জন্মাবে!

    এহেন অ্যাম্বাসাডরের খারাপ দিন শুরু হল নয়ের দশক থেকে। আশির শেষ অবধি ফিয়াট, মারুতির সঙ্গে লড়েও সত্তর শতাংশের বেশি গাড়ির বাজার ধরে রেখেছিল অ্যাম্বাসাডর। কিন্তু, নব্বইতে উদারীকরণের জোরালো স্রোতে ভেসে এ দেশের রাস্তায় চলে এল হন্ডা, মার্সিডিজ, বিএমডব্লু, টোয়োটা, ফোর্ডের মতো গাড়ির ঝাঁক। এইসব ঝাঁ চকচকে গাড়িদের সঙ্গে পাল্লা দিতে ১৯৯৯-তে নিজের আদল বদলাল অ্যাম্বাসাডরও। এল অ্যাবাসাডর নোভা। তারপর একে একে ‘অ্যাভিগো’, ‘ক্লাসিক’, ‘গ্রান্ড’ ও ‘এনকোর’। অত্যাধুনিক গিয়ার লিভার, ছাদ, দরজা, সাসপেনসন, বাম্পারের রং, শীতাতপের যন্ত্র-সহ একশো তিরিশের বেশি বদল হয় তার শরীরে। তবু, ততদিনে সে ব্যাকডেটেড। শহরের তো বটেই, গোটা দেশের নতুন রুচি তাকে আর চাইছে না। গাম্ভীর্য, আভিজাত্য, বৈভব, অহমিকা পৃথিবীর থেকে পিছলে তার পরিচয় এসে আটকেছে হলুদ ট্যাক্সিতে। 

    যদিও, সেখানেও নিজের জাত চিনিয়েছে সে। ২০১৩-তে বিবিসির টপ গিয়ার অনুষ্ঠানে ব্রিটেন, আমেরিকা, রাশিয়ার প্রতিদ্বন্দ্বী ট্যাক্সিদের হারিয়ে ‘শ্রেষ্ঠ ট্যাক্সি’-র খেতাপ ছিনিয়ে নিয়েছে ‘অ্যাম্বি’-ই। তবুও তার গেছে যেদিন, সে আর ফিরবে না। মুনাফা কমলে মালিক ব্যবসা গুটিয়ে নেয়। ইতিহাসের নিয়ম। সেখানে হাজার হাজার শ্রমিকের রুটি-রুজি-আবেগ-জীবনধর্ম গৌণ। গৌণ একটা গাড়িকে ঘিরে তৈরি হওয়া গোটা এলাকার অর্থনীতি, পরিচিতি, চরিত্র। গৌণ শহরের স্মৃতি, গৌরব, ঐতিহ্য। মুনাফা দিতে অক্ষম রাজকীয় বুড়ো অ্যাম্বাসাডরের তাই আনুষ্ঠানিক মৃত্যু পরোয়ানা জারি হল ২০১৪-র ২৫ মে। মৃত্যু অবশ্য শুরু হয়েছিল আগেই। তিলে তিলে। শোনা যাচ্ছে, ফরাসি কোম্পানির কাছে বেচেও দেওয়া হয়েছে তাকে। সে আর বাংলার ভূমিসন্তান থাকবে কিনা, তা এখন বিলিতি মালিকদের ইচ্ছে।

    হিন্দমোটরের কারখানার সামনেটা এখন শুনশান। গৌরবের অধ্যায় শেষ। সকাল-দুপুর আর গাড়ি বেরোয় না। সেই গাড়ি, যাতে অনায়াসে ঢুকে যেতে পারত গোটা পরিবার। সঙ্গে তল্পি-তল্পা সহ গোটা সংসার। ৫৪ লিটার তেলের ট্যাঙ্ক নিয়ে যে গাড়ি দৌড় দিত বহুদূরের পথ। টাকা উড়ে যেতে দিত না মধ্যবিত্তর। এখন পৃথিবীটাই অন্য নিয়মে চলে। নবারুণ বলেছিলেন না, ‘ঝিনচ্যাক ছাড়া কিছু থাকবে না।’ এই ঝিনচ্যাক, ইউজ অ্যান্ড থ্রোর দেখনদারি দুনিয়ায় অ্যাম্বাসাডর সত্যিই সেকেলে। 

    তার চাইতে তার স্মৃতিতে থাকাই ভালো। 

    ঋণ: রোববার, প্রতিদিন, ১৮ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮, Mazur, Eligiusz, ed. (2006). World of Cars 2006-2007. 

    বঙ্গদর্শনের সপ্তাহের বাছাই করা ফিচার আপনার ইনবক্সে পেতে

    @