সাধের ‘বাতিল’ ভালোবাসাদের ফেলে রেখে চলে গেলেন নকুবাবু

পড়ন্ত বিকেল। ট্রাম লাইনের ধার ঘেঁষে ধুলো উড়ে যাচ্ছে। উত্তরের গলিপথের দেওয়ালে শ্যাওলা জমেছে বেশ। এরকমই কলকাতা উত্তরের শ্যাম চাঁদ মিত্র লেনের একটা পুরোনো জীর্ণ তিনতলা বাড়ির এক ঘরে প্রেমের বাতি জ্বালিয়ে রেখেছেন সুশীলকুমার চট্টোপাধ্যায় ওরফে নকুবাবু। এই ঘর জুড়েই রয়েছে তাঁর নিজস্ব বিরল ধনসম্পদ। বাঙালিয়ানার আয়নায় দেখা মুখ। ঝিকমিকিয়ে উঠছে কলকাতার অজস্র স্মৃতি। চিলেকোঠার রেলিং চোঁয়ানো অন্ধকার বেয়ে তখনই নেমে আসছেন ৯৫ বছরের এই বৃদ্ধ।
ছবিঃ অভিজিৎ চক্রবর্তী
এই ঘটনা কিছুদিন আগের। কিন্তু এখন সবটাই ইতিহাস। আজ সকালে এই বিশ্বের মায়া ত্যাগ করে চলে গেলেন নকুবাবু। ছোটোবেলা থেকেই তাঁর শখ ফেলে দেওয়া জিনিসপত্র সংগ্রহ করে রাখা। মালিকরা অনেক জিনিসই এদিক সেদিক ফেলে রেখেছিলেন। তাতে ছিল অবহেলা। সেইসব জিনিসই পরম যত্নে লালন করেছেন নকুবাবু। আসলে তিনি একা হাতে বহন করছেন আমাদেরই অতীতকে।
ছবিঃ অভিজিৎ চক্রবর্তী
ফ্রিল্যান্স ফটোগ্রাফার অভিজিৎ চক্রবর্তী নকুবাবু এবং তাঁর সংগ্রহকে জীবন্ত করে তুলেছেন। অভিজিতের লেন্সে ধরা পড়েছে নকুবাবুর জাদুঘর। তাঁর সংগ্রহে ছিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তরকালীন চলচ্চিত্র ক্যামেরা, পকেট মাইক্রোস্কোপ, ১৭৭৭ সালে ব্রিটিশদের ব্যবহৃত শামুকের বোতাম, অষ্টাদশ শতকের কলিং বেল, বিভিন্ন সময়ের ফিল্ম ক্যামেরা এবং প্রজেক্টার, পিয়ানো, রেকর্ডস আরও কত কিছু! বাবার প্রতি ভালোবাসায় নকুবাবুর বড়ো ছেলে উত্তরাধিকার সূত্রে এইসব ধনসম্পদ বাঁচিয়ে রাখবেন বলে কথা দিয়েছেন।
ছবিঃ অভিজিৎ চক্রবর্তী
সেকালের লণ্ঠন, রেকর্ডের মৌতাত, ইতিহাসের ছায়া বিস্তার করে রেখেছিল তাঁর ছোট্ট এই ঘর। তাঁর স্বপ্নের মায়ায় জড়িয়ে থাকে ধলভূমগড়, সবুজ জ্যোৎস্না কিংবা বিভূতিভূষণ। অসম্ভব দ্রুততায় বদলে যাওয়া চারপাশ থমকে দাঁড়াত তাঁর চৌকাঠ পেরোতেই। ফটোগ্রাফার অভিজিৎ চক্রবর্তীর মতে, “তিনি ছিলেন এই অসুস্থ সময়ের এক উজ্জ্বল ব্যতিক্রম। যে উজ্জ্বলতা তাঁর বাতিঘরের সকল দুয়ার খুলে ছিটকে এসে চকমকি জ্বেলে দেয় আমাদের অন্ধকারে।”
ছবিঃ অভিজিৎ চক্রবর্তী
নকুবাবু চলে গেলেন। তাঁর প্রতি রইল আমাদের শ্রদ্ধা, সম্মান।