No Image

   

00:00
00:00
Volume

 0 Songs

    মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের মৃত্যু, ‘সব মরণ নয় সমান’

    মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের মৃত্যু, ‘সব মরণ নয় সমান’

    Story image

    ‘ফুলগুলো সরিয়ে নাও,
    আমার লাগছে।
    মালা
    জমে জমে পাহাড় হয়
    ফুল জমতে জমতে পাথর।

    পাথরটা সরিয়ে নাও,
    আমার লাগছে।’ (পাথরের ফুল/ সুভাষ মুখোপাধ্যায়)

    -এই কবিতা পড়তে পড়তে বড় হয়েছি আমরা। জেনেছি এই কবিতা এমন এক রুদ্ধ বাস্তবের আঁচে পুড়তে পুড়তে লেখা যা স্মৃতি প্রতারিত বাঙালির চিকন নিদ্রাঘরে কড়াঘাত করে যাবে, যতদিন বাংলাভাষা থাকবে। সাঁত্রে বলেছিলেন, মৃত্যুকে আমি ঘৃণা করি, কারণ মৃত্যুর পর আমার আর নিজের পরিচয় গঠনের অধিকার থাকে না। দেহ পড়ে থাকে। আর আমি কেমন ছিলাম তা নিয়ে অনেক কথা হয়। যারা ‘অপর’ তারা আমার পরিচয় নির্ধারণ করতে থাকবেন। ‘অন্যেরা কথা কবে, তুমি রবে নিরুত্তর’ আর কী। সে তো যে কোনও মৃত্যুর পরই একই সমাপতন ঘটে। কিন্তু ‘পাথরের ফুল’ তখনই লেখা হয়, যখন গাইতে হয় ‘সব মরণ নয় সমান’। কেননা এই মৃত্যু দৃশ্য মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের। আর তাঁর মৃত শরীরে রাখা পুষ্পস্তবকের পাহাড় কেন পাথর তা বুঝতে গেলে মানিকবাবুর রচনা সম্পর্কে অবজ্ঞাত হওয়া যেমন জরুরী, ঠিক তেমনই প্রয়োজনীয় তাঁর জীবনের শেষ দিনগুলির কথা জানা। আর এই ঐতিহাসিক কাজটি করেছেন সন্দীপ বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর ‘মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের মৃত্যু’ বইয়ে।

    এই লেখা যখন লিখছি তার পরের দিন অর্থাৎ ৩ ডিসেম্বর মানিকবাবুর মৃত্যুদিন। তবে এই লেখা সন্দীপবাবুর বইয়ের কোনও মূল্যায়ণ বা সমালোচনা নয়, বরং সেই বই পড়ে বছর দুয়েক আগে যেসব কথা বলা উচিত বলে মনে হয়েছিল তার স্মৃতিচারণও বলা যায়। আবার বলা যায় বইটির সাহায্য নিয়ে ‘মোষের সিংয়ে মৃত্যু বাঁধা’ জেনেও লাল নিশান ওড়ানো একটি জীবন প্রদীপ নির্বাপণের কয়েকটি প্রহর মনে করিয়ে দেওয়া।

    ১৯৫৪-র শেষ দিক থেকেই শরীর ক্রমশ ভাঙছিল মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের। মেজাজও ঠিক থাকছিল না। কামাক্ষীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়কে বলেন, পুতুলনাচের ইতিকথা একটা ‘ন্যাতপেতে সেন্টিমেন্টাল’ লেখা। এ ভাবেই জীবনের প্রথম পর্বের অসামান্য সব রচনাকে বাতিল করে দিচ্ছিলেন তিনি। আদ্যন্ত কমিউনিস্ট মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় ডায়রিতে লিখছেন তাঁর আধ্যাত্মিক সমর্পণের কথা। কোথাও লিখে টাকা পেলে ডায়রিতে লিখছেন, ‘মায়ের দয়া ও ক্ষমা’। বহু চেষ্টা করেও ছাড়তে পারছেন না মদ্যপান ও সিগারেট। অথচ কাহিল করে দিচ্ছে গ্যাসট্রাইটিস ও মৃগী। বাড়ছে অর্থাভাব, কিন্তু ফিরিয়ে দিচ্ছেন রাজ্যসরকারের সামান্য সাহায্য, কেননা তিনি যে কমিউনিস্ট। মুড়ির ঠোঙার কাগজে গল্প লিখে পাঠাচ্ছেন পরিচয়ের দপ্তরে। পাশে পাননি তাঁর কমিউনিস্ট পার্টিকেও। প্রথমবার হাসপাতালে থাকার সময় ডায়রিতে অভিযোগ জানিয়েছেন, তাঁকে ভর্তি করে দিয়ে সবাই সরে পড়েছে। নেতারা বড় একটা কেউ আসে না। তবে সে অভিযোগের পিছনে আছে কিছুটা জমাট বাধা অভিমান। কেননা তখন তাঁর দেখাশোনা করছেন পার্টির তিন সদস্য- সুভাষ মুখোপাধ্যায়, দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় এবং প্রসূন বসু। মাঝে মাঝেই দেখতে আসেন তরুণ তুর্কি দীপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়। আড়াল থেকে বটবৃক্ষের ছায়া দিচ্ছেন অতুলচন্দ্র গুপ্ত। এদের সবার উদ্যোগে চাঁদা তোলা হচ্ছে। যোগ দিচ্ছেন তারাশঙ্কর, সজনীকান্ত দাস, গোপাল হালদারের মতো ব্যক্তিত্বরা।

    মানিক শিশুদের সঙ্গে খেলতে ভালোবাসতেন, ভালোবাসতেন বাঁশি বাজাতে। এসবই এই সময় বন্ধ হয়ে যায়। স্বাস্থ্যের অবনতির কারণে প্রয়োজন হাসপাতালে ভর্তি হওয়া। কিন্তু মানিক নারাজ। শেষ পর্যন্ত ১৯৫৫-র ২৪ ফেব্রুয়ারি মুজফ্‌ফর আহমেদ এবং জ্যোতি বসুর চেষ্টায় তাঁকে ভর্তি করা হল ইসলামিয়া হাসপাতালে। হাসপাতালে থাকতেই ডায়রিতে লেখেন, কমিউনিস্ট পার্টি ভারতের (জনগণের) মন বোঝে না। দিনে দিনে বেশ সুস্থ হয়ে উঠছিলেন। কিন্তু তারপরই তাঁর মনে হতে লাগল তাঁকে হাসপাতালে বন্দি করে মদ ছাড়ানোর মতলব চলছে। ২৭ মার্চ ডাক্তার-নার্স কারুর কথা না শুনে বৃষ্টির মধ্যে একটা ট্যাক্সি ধরে বাড়িতে চলে এলেন। কিছুদিন স্বাভাবিক, কিন্তু তারপর পরই আবার অবনতি। দেবীপ্রসাদের উদ্যোগে মানিকবাবুকে দেখতে এলেন সেকালের বিখ্যাত চিকিৎসক যোগেশ ব্যানার্জি। তিনি রোগী দেখে রোগীর সঙ্গে কথা বলে জানালেন, লিভার তত কিছু খারাপ নয়, আসল সমস্যা মৃগী বা এপিলেপসি। ফিট হওয়ার আগে একটা আভাস পেয়ে মদ খেয়ে অ্যাটাক আটকাতে চেষ্টা করেন মানিকবাবু। সেই কারণেই উনি মদ ছাড়তে পারছেন না। মানসিক হাসপাতালে রেখে ওষুধ খাইয়ে এপিলেপসি সারিয়ে দিতে পারলেই মানিকবাবু মদ ছেড়ে দেবেন। উদ্যোগ নিয়ে ১৯৫৫-র ২০ আগস্ট তিলজলার লুম্বিনী পার্ক মানসিক হাসপাতালে মানিককে ভর্তি করে দেন দেবীপ্রসাদ। সেখানেই তাঁর সঙ্গে দেখা হয় সঞ্জয় ভট্টাচার্য্যের। বছর কুড়ি আগে মানিক যখন তাঁর ‘পদ্মানদীর মাঝি’ নিয়ে দোরে দোরে ঘুরছিলেন তখন সঞ্জয় ভট্টাচার্য্যই এই উপন্যাস ছেপেছিলেন পূর্বাশায়।

    লুম্বিনী পার্ক হাসপাতাল থেকে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরলেও মদ ছাড়তে পারেননি মানিক। তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস ছিল তাঁর চিকিৎসা তিনি নিজেই করতে পারবেন। কলেজস্ট্রিটের ফুটপাথ থেকে কেনা মেডিসিনের বই দেখে নিজেই চিকিৎসা করেছেন। ভয়ানক রক্ত আমাশায় ধরলো ১৯৫৬-র জুন মাসে। বুঝতে পারছিলেন পরাজয়ের সময় আসছে। মৃত্যুর সামনে দাঁড়িয়ে নিষ্ঠুর পরাজয়কে যেন চোখ রাঙাচ্ছিলেন মানিক। ২ ডিসেম্বর ভর্তি করা হল নীলরতন সরকার হাসপাতালে। ৩ তারিখ মৃত্যু হল তাঁর। সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কাছ থেকে টেলিফোনে খবর পেলেন দেবীপ্রসাদ। অতুলপ্রসাদ গুপ্তকে খবর দিতে তিনি তাঁর হাতে তুলে দেন ঘাট খরচ এবং মানিকবাবুর পরিবারের জন্য কিছু আর্থিক সাহায্য। হাসপাতালে পৌঁছে দেবীপ্রসাদ দেখলেন ডেথ সার্টিফেকেটে মৃত্যুর কারণ লেখা রয়েছে ‘স্টেটাস এপিলেপটিকা’। গত কয়েক দিন ধরে মানিকবাবুকে বাঁচাতে অমানুষিক পরিশ্রম করেছেন তিনি। হয়তো লোকমুখে বারবার তাঁকে শুনতে হয়েছে মদ খেয়েই শেষ হয়ে গেল লোকটা। এবার আর থাকতে পারলেন না। খেপে গিয়ে ডেথ সার্টিফিকেট তুলে চিৎকার করে দেবীপ্রসাদ বলতে লাগলেন, আপনারা শুনে নিন-মানিকবাবু মদ খেয়ে মরেননি, লিভার সিরোসিসে মরেননি।– তার গলা ভেঙে গেল।

    তারপর শুরু হল নাটক। হাসপাতালে জড়ো হতে লাগলো একের পর এক লোক। ‘স্বাধীনতা’ পত্রিকার সাংবাদিক, ট্রাম শ্রমিকদের বামপন্থী ইউনিয়নের নেতাকর্মীরা উপস্থিত। এসেছেন পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায়, সজনীকান্ত দাস, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়। লোকে লোকারণ্য হয়ে উঠছে হাসপাতাল। আসছে রাশি রাশি ফুলের তোড়া। এল পালঙ্কের মতো বিরাট খাট, বিশাল সরকারি ট্রাক। বেলা দশটায় ফুলে ফুলে সাজান দেহটা তুলে দেওয়া হল তাতে। বুকের উপর বিছিয়ে দেওয়া হল লাল পতাকা।

    তারাশঙ্কর খবর পাঠালেন দিল্লি থেকে। তিনি কলকাতায় না পৌঁছনো যেন শেষ কাজ সম্পন্ন না করা হয়। জেলা কমিটির অফিসে শ্রদ্ধা জানালেন মুজফ্‌ফর আহমেদ, ভবানী সেন, মণিকুন্তলা সেন, গোপাল হালদার, জলি কাউল প্রমুখ। এসেছেন বিষ্ণু দে, মনোজ বসু, বিবেকানন্দ মুখোপাধ্যায়, জগদীশ ভট্টাচার্য, শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়, নরেন্দ্র দেব, বিমল মিত্র, নরেন্দ্রনাথ মিত্র। শহর জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে খবর। বন্ধ রাখা হয়েছে বরানগর পুরসভা। ছুটি হয়ে গেছে  হিন্দু স্কুল। সাহিত্যপাগল জগণের হাতে চলে গেছে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের দেহ। একটা লরিতে তাঁর দেহ ফুলে ঢাকা। তবু সব ফুল তাতে ধরান যায়নি। তাই তাঁকে নিবেদিত ফুল নিয়ে পিছনে আরেকটা লরি। ফুলের ভারে হেলে পড়ছে খাট। স্বাধীনতা পত্রিকার অফিস, ৩৩ আলিমুদ্দিন স্ট্রিটে মালা দিলেন সরোজ মুখোপাধ্যায় এবং সাংবাদিক সরজ দত্ত। এরপর ধর্মতলায় প্রগতি লেখক সঙ্ঘ এবং ভারত-সোভিয়েত মৈত্রী সঙ্ঘের দপ্তর। যোগ দিলেন ননী ভৌমিক, মনীন্দ্র রায়, নবেন্দু ঘোষ। বউবাজার স্ট্রিটের কমিউনিস্ট পার্টির অফিসে হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়, জ্যোতি বসু, বঙ্কিম মুখোপাধ্যায়, নিরঞ্জন সেন। বইপাড়ায় ম্নোজ বসু, গজেন্দ্র মিত্র, প্রবোধ সান্যাল, শচীন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ।

    এত জনজোয়ারের ভিতর দিয়ে নিমতলায় পৌঁছতে পৌঁছতে সন্ধ্যে হয়ে গেল। চিতা জ্বলল সন্ধ্যে আটটার পর। ততক্ষণে এসে পড়েছেন তারাশঙ্কর।

    এত বড় শব যাত্রা, এত মানুষ, এত অশ্রুপাত জীবদ্দশায় মানিক পাননি। তবে তাঁর নিরুত্তর দেহ পেয়েছিল। তিনি মরে প্রমাণ করেছিলেন কেবল পার্টির নয়, তিনি ছিলেন অগণিত বাংলাভাষাভাষীর লেখক। সাহিত্যের জন্য জীবনকে বাজি রাখতে আর ক’জন বাঙালি লেখক জন্মেছেন বা জন্মাবেন জানিনা, তবে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের মৃত্যু আমাদের বারবার শেখায় ‘সব মরণ নয় সমান’

    বঙ্গদর্শনের সপ্তাহের বাছাই করা ফিচার আপনার ইনবক্সে পেতে

    @