বৌদির কপালে রক্ত দেখে খুন চেপে গেল দাদার মাথায়

কর্পোরেশন স্কুলে আমরা একমাসও পড়িনি। দাদা আমাকে বউবাজার হাই স্কুলে ভর্তি করে দিল। আর, ছোটদিকে তার ঠিক পাশেই একটা মেয়েদের স্কুলে। ওয়ান, টু ক্লাসে পড়িনি আমরা। দুজনেই সোজা গিয়ে ঢুকলাম ক্লাস থ্রিতে।
আমি কিন্তু সুযোগ পেলেই আমাদের স্কুল থেকে পালিয়ে চলে আসতাম ছোটদির স্কুলে। ছাব্বিশে জানুয়ারি ওদের স্কুলে লাইন দিয়ে কমলালেবু দিত। আমিও ছোটদির হাত ধরে সেই লাইনে। সরস্বতী পুজোর খিচুড়ি খাওয়ার সময়ও আমি ছোটদির স্কুলে পাত পাততুম। ওদের স্কুলে ফাংশান হলে আমি মঞ্চের পাশে গ্রিনরুমে অবাধ ঘুরে বেড়াতাম। আমায় সবাই ভালবাসত। কেউ কিছু বলত না।
স্কুল থেকে ফেরার সময়ও আমরা দু’জন একসঙ্গে ফিরতাম। আমি ট্রাম লাইনের ওপর দিয়ে হাঁটতে চাইলে ছোটদি আমাকে সেখান থেকে টেনে এনে ফুটপাত দিয়ে হাঁটতে বাধ্য করত। আমি ছোটদির হাত থেকে নিজেকে মুক্ত করে আবার ট্রামলাইনের দিকে ছুটতে চেষ্টা করলে ছোটদি ট্রামলাইন ছেড়ে ডানদিকের গলি দিয়ে আমাকে টেনে নিয়ে চলত।
কলকাতায় আমাদের বাসা যে গলিতে ছিল, সে-গলির নাম ‘রাম ব্যানার্জী লেন’। প্রেমচাঁদ বড়াল স্ট্রিট ধরে মেডিকেল কলেজের দিকে হাঁটলে ডানদিকে পড়ে ওই সরু গলিটা। ওই গলিরই ১১বি নম্বর বাড়ির দোতলায় আমাদের ঘর। পাশের ঘরে থাকেন বাবা, মা ও একটি মেয়ে নিয়ে তিনজনের পরিবার। মেয়েটার নাম গীতা। তার মা’কে সবাই ডাকে ‘গীতার মা’ বলে।
প্রেমচাঁদ বড়াল স্ট্রিটের প্রায় অর্ধেকটা জুড়ে রাস্তার দু’পাশে মেয়েরা সেজেগুঁজে দাঁড়িয়ে থাকত। আর ছিল সোনার অলঙ্কার যারা তৈরি করত তাদের ছোট-ছোট অন্ধকার ঘুপচি ঘর এবং তাদের হাতুড়ি ঠোকার ঠুংঠাং শব্দ।
আমাদের বাড়িতে স্নো-পাউডারের ব্যবহার ছিল না। বৌদি সাধারণ গ্রামের মেয়ে। বিকেলে মুখ-হাত-পা ধুয়ে, শাড়ি পাল্টে, কপালে সিঁদুর দিয়ে আমাদের নিয়ে গল্পগুজব করত। সন্ধেয় নিচের গেটে কড়ানাড়ার শব্দ হলেই বৌদি আমাকে বলত – ‘দ্যাখ তো, তোগো দাদা আইলো বোধঅয়।’
কলকাতায় আসার পর আমাদের যে রোগটা প্রায় সব্বাইকে আক্রান্ত করেছিল তা হল ফোঁড়া ও পাঁচড়া। প্রায় ঘরে-ঘরে ছিল তার প্রাদুর্ভাব। বৌদি মায়ের মতো করে গরম জল দিয়ে পরম যত্নে আমার পাঁচড়া ধুয়েমুছে পরিষ্কার করে দিত। আমি ‘দুক্কু লাগে, দুক্কু লাগে’ বলে ব্যথায় চেঁচিয়ে উঠলে বৌদি আমায় বলত – ‘কাঁদলে আইজ কিন্তু দুধের কড়াইয়ের চাছা তোরে দিমু না।’ ব্যস। এক কথাতেই আমার ‘দুক্কু’ উধাও।
দেশের বাড়িতে থাকতে আমরা আমাদের গাইগরু ময়নার দুধ খেতাম। এখানে প্রথম-প্রথম আমরা দুধের ছায়াও দেখিনি। তারপর দাদা আধসের করে দুধের বন্দোবস্ত করল। সেই দুধে আমাদের চা-টা যেমন হত, তেমনি রাতে রুটির সঙ্গেও একটু মিলত। তবে দুধের চেয়ে দুধ জ্বাল দেওয়া কড়াই চাঁছা খাওয়ার জন্য ছোটদিও আমার সঙ্গে প্রায়ই ঝগড়া লাগাত। ঝগড়া মেটাতে বৌদি – একদিন আমি চাঁছা খাব, আরেকদিন ছোটদি খাবে – এই বন্দোবস্ত বেঁধে দেওয়ায় ঝগড়ার নিষ্পত্তি হয়।
একদিন দেখি বৌদির কপালে দুটো ফোঁড়া মার্বেলের মতো ফুলে উঠেছে। লাল হয়ে উঠে একসময় সে-ফোঁড়ায় পাক ধরল। বৌদি সেই পাকা ফোঁড়ার যন্ত্রণায় একেবারে কাহিল।
সেই অবস্থায় একদিন নিচের কলে জল তুলতে গিয়ে কলের সামনের ঘরের ভাড়াটেদের মেয়ে হেলির সঙ্গে বৌদির ঝগড়া বেঁধে গেল। ঝগড়া থেকে এক্কেবারে হাতাহাতি – হেলির নখের আঁচড় লেগে বৌদির কপালের একটা ফোঁড়া ফেটে পুঁজরক্ত বেরিয়ে বিকট কাণ্ড। কপালে হাত দিয়ে বৌদির – ‘আমারে মাইরা ফালাইলো মাইরা ফালাইলো’ বলে সে কী চিৎকার!
গীতার মা দৌড়ে সিঁড়ি দিয়ে নেমে বৌদিকে ওপরে নিয়ে এল। তারপর বৌদির সেবা শুশ্রূষা যা করার, গীতার মা-ই করল।
দাদা কম্পাউন্ডারের কাজ করত। সকালে একটা হাসপাতালে যেত। দুপুরে ফিরে এসে ভাত খেয়ে আবার যেত লালবাজারের কাছে একটা ফার্মেসিতে।
সেদিন দুপুরে দাদা বাড়ি ঢুকতেই বৌদি রক্তমাখা কপাল দেখিয়ে চিৎকার করে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল আর বলল – ‘হেলি আমার কী অবস্থা করছে দ্যাখো...’
বৌদির রক্তমাখা কপাল দেখে দাদার মাথায়ও রক্ত উঠে গেল। বাঙালের রাগ। ‘হেলি, এই হেলি, কই দেখি তোর কত গায়ের জোর’ – বলে চিৎকার করতে করতে দাদা সিঁড়ি দিয়ে উন্মাদের মতো নামতে লাগল। হেলি, হেলির মা ও ছোটভাই দাদার ভয়ে ঘরে ঢুকে খিল দিয়ে বসে রইল। দাদা একটা লোহার রড দিয়ে ক্রমাগত ওদের দরজা পেটাতে লাগল আর চিৎকার করে বলতে লাগল – ‘আয় দেখি তোর কত গায়ের জোর!’
এবারেও ছুটে গেলেন গীতার মা। দাদার হাত থেকে লোহার রডটা কেড়ে নিয়ে একধাক্কায় হেলিদের দরজা থেকে সরিয়ে দিলেন দাদাকে। বললেন – ‘এ আপনি কী করছেন গোপালবাবু! আপনি কি পাগল হয়ে গেলেন!’
শেষমেশ দাদার রাগ পড়ল। বৌদির ফোঁপানি থামল। দাদা খেয়ে বিকেলে ডিউটিতে বেরিয়ে গেল।
রাত আটটা নাগাদ দাদা বাড়িতে ঢুকতে-না-ঢুকতে পাড়ার একদল লোক দাদাকে ঘিরে প্রচণ্ড শোরগোল তুলল। মেয়েমানুষের গায়ে হাত দেওয়ার অভিযোগে দাদাকে সকলে এই মারে কি সেই মারে।
জনতার আদালতে মাপ চেয়ে সেবারের মতো মুক্তি পেল দাদা। যখন উপরে উঠে এল, দাদার মুখটা অপমানে একেবারে আলকাতরা মাখানো।
গীতার মা আবারও এগিয়ে এলেন। দাদাকে বললেন – ‘যান গা ধুয়ে এসে একটু শান্ত হয়ে বসুন।’
অপমানের যাতনায় দাদার চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে। গীতার মা দাদাকে বললেন – ‘আপনাকে একটা কথা বলছি গোপালবাবু, সবসময় খেয়াল রাখবেন। স্বামী কাজ থেকে পরিশ্রম করে বাড়িতে এলে যে বউ সঙ্গে সঙ্গে স্বামীকে লাগায়, সে বউ স্বামীর কোনোদিন উপকার করতে পারে না।’
ছোটদি গীতার মাকে ফিসফিস করে বলল – ‘কাকি, বৌদি শুনব, আপনে থামেন।’
বৌদি, যন্ত্রণা নিয়ে ঘরে শুয়ে থাকতে থাকতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিল কে জানে! এত কাণ্ড যে সন্ধে থেকে হয়ে গেল, তার কিছুই বৌদি টের পায়নি।
গীতার মা বৌদিকে একবার উঁকি দিয়ে দেখে নিজের ঘরে ঢুকে গেলেন।
দাদা তখন নিচের চৌবাচ্চা থেকে ছোট্ট বালতি দিয়ে জল তুলে অবিরত মাথায় জল ঢেলে যাচ্ছে গামছা পরে।
ছোটদি বৌদিকে ঠেলে জাগিয়ে বলল – ‘বৌদি আমাগো রাতের খাওন দিবা না...’
বৌদি ধড়মড় করে বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। ছোটদি বৌদিকে জিজ্ঞাসা করল – ‘এখনও তোমার দুক্কু আছে বৌদি?’ বৌদি জিজ্ঞাসা করল – ‘তোগো দাদা আইছে?’ আমি বললাম – ‘হ! নিচে চান করে...।’
(ক্রমশ)