বীরভূমের ইতিহাসে পৌরাণিক এবং তান্ত্রিক প্রসঙ্গ

দক্ষযজ্ঞে সতী দেহত্যাগ করিলে মহাদেব তাঁহার মৃতদেহ স্কন্ধে লইয়া ত্রিভুবন ভ্রমণ করিতে করিতে উন্মত্তের ন্যায় নৃত্য করিতে থাকেন। বিষ্ণু সেই দেহ চক্রদ্বারা ছেদন করিলে উহার কর্ত্তিত অংশ যে যে স্থানে পতিত হয়, সেই সেই স্থান মধ্যে ৫১টি মহাপীঠ এবং ২৬টি উপপীঠ নামে তীর্থস্থল রূপে পরিণত হয়। ভারতের সর্ব্বত্র এই পীঠস্থানগুলি বিচ্ছিন্নভাবে অবস্থিত আছে। বীরভূমের সৌভাগ্য যে এখানে বক্রেশ্বর, অট্টহাস(ফুল্লরা), সাঁইথিয়া সংলগ্ন নন্দীপুর, নলহাটি, কঙ্কালীতলা প্রভৃতি মহাপীঠ ও উপপীঠ স্থান পাইয়া ধন্য হইয়াছে। এতদ্ব্যতীত, তারাপুর প্রভৃতি সিদ্ধপীঠও বীরভূম মধ্যে অবস্থিত।

বক্রেশ্বর সম্বন্ধে পৌরাণিক উপাখ্যান এই যে – সত্যযুগে ভগবান নরসিংহ মূর্তি ধারণ করিয়া হিরণ্যকশিপুকে নিহত করেন। হিরণ্যকশিপু ব্রাহ্মণ সন্তান। তাঁহাকে বধ করায় নারায়ণের ব্রাহ্মণ-হত্যার পাপ ঘটে এবং তাঁহার হস্ত ও পদনখে বিষম জ্বালা সমুদ্ভুত হয়। ভগবান, দেব-সমাজে ও ঋষিমণ্ডলে এই কথা প্রকাশ করিলে অষ্টাবক্র ঋষি সেই জ্বালা আপন মস্তকে ধারণ করিতে সম্মত হন। ভগবান প্রথমে অস্বীকার করিয়া পরে ঐ ‘জ্বালা’ অষ্টাবক্রের মস্তকে অর্পণ করেন। ভগবান ভক্তের অশেষ যন্ত্রণা দেখিয়া জ্বালা নিবারণের প্রতিবিধানকল্পে বক্রেশ্বর শিবের মস্তক স্পর্শ করিয়া অষ্টাবক্র ঋষিকে উপবেশন করিতে আদেশ করেন এবং ইহাও নির্দ্দেশ কইয়া দেন যে, ভারতের যাবতীয় পবিত্র তীর্থবারি সুড়ঙ্গ দ্বারা আনীত হইয়া তাঁহার মস্তকে পতিত হইবে, তাহা হইলে ঐ দারুণ-জ্বালা নিবারিত হইবে। এই বারিধারা, জ্বালা স্পর্শে উষ্ণভাব ধারণ করিয়া স্থানান্তরে নির্গত হইয়া নিকটস্থ পাপহরা নদীতে পতিত হইতে থাকে।
দুবরাজপুরের ছয় মাইল দক্ষিণ-পশ্চিমে অজয় নদীতীরে পরিখা প্রাকার চিহ্নিত গড় ও দুর্গের ভগ্নাবশেষ পরিদৃষ্ট হয়। কথিত আছে যে এই অঞ্চলে পঞ্চপাণ্ডব কিছুকাল অজ্ঞাত বাস করেন। পঞ্চভ্রাতার নামানুসারে ভীমগড়া, যুধিষ্ঠিরপুর, অর্জ্জুনপুর প্রভৃতি পাঁচটি গ্রাম ও পাঁচটি শিব আছে। এতদ্ব্যতীত, অজয় নদীর অপর তীরে পাণ্ডবেশ্বর নামে একটি সমৃদ্ধশালী গ্রাম ও রেলওয়ে জংশন ষ্টেশন আছে।
দুবরাজপুরের জঙ্গলাকারে পতিত বড় বড় পাথর সম্বন্ধে প্রবাদ এই যে – শ্রীরামচন্দ্র হিমালয় হইতে রথে করিয়া বড় বড় পাথর লঙ্কাভিমুখে লইয়া যাইবার কালীন এই স্থানে ফেলিয়া যান। অপর প্রবাদ যে শিবের আদেশানুযায়ী বিশ্বকর্ম্মা এখানে এক রাত্রিতেই দ্বিতীয় কাশী নির্ম্মাণ করিবার জন্য বিস্তর পাথর সংগ্রহ করেন; কিন্তু রাত্রি প্রভাত হওয়ায় তাহা আর কার্য্যে পরিণত হয় নাই!
এখনকার পাহাড়েশ্বর শিবের পূর্ব্বদিকে একটি বড় ফাঁপা পাথরের মধ্যে সমগ্র বৎসর জল দেখিতে পাওয়া যায়। প্রবাদ যে সীতাদেবী এই জলে তাঁহার মস্তক ধৌত করিয়াছিলেন।
সিউড়ীর ছয় মাইল পশ্চিমে ভাণ্ডীরবনে অনাদিলিঙ্গ শিব প্রতিষ্ঠিত আছেন। ইনি ‘সিদ্ধনাথ’ বলিয়া খ্যাত। কথিত আছে যে রামায়ণোক্ত ঋষি বহুকাল ধরিয়া এই শিব পূজা করায় ঋষির নামানুসারেই ইনি ভাণ্ডেশ্বর শিব বলিয়া অভিহিত হন।
লাভপুরের দুই মাইল দক্ষিণ-পশ্চিমে গোপালপুর গ্রামের নিকটস্থ স্থানে দুর্ব্বাসা ঋষির আশ্রম ও তপস্যা-ভূমি ছিল বলিয়া কথিত হয়। দুর্ব্বাসা ঋষির আশ্রমের সান্নিধ্য অনুসারে গোপালপুর ‘দুবসো গোপালপুর’ নামে অভিহিত হইয়া থাকে।
বোলপুরের তিন মেইল পূর্ব্ব-উত্তরে শিয়ান গ্রামে বিভাণ্ডক ঋষির আশ্রমস্থল ছিল বলিয়া কথিত আছে। জনশ্রুতি এই যে, অঙ্গরাজ লোমপাদ বিভাণ্ডকপুত্র ঋষ্যশৃঙ্গকে ভুলাইয়া আপন রাজধানীতে আনিয়া কন্যা সম্প্রদান করিলে বিভাণ্ডক মুনি উক্ত আশ্রম পরিত্যাগ পূর্ব্বক ভাণ্ডীরবনে আসিয়া নূতন আশ্রম ও তপস্যাভূমি প্রতিষ্ঠিত করেন। বিভাণ্ডক ঋষির আশ্রম ও তপস্যাভূমি বলিয়া এই স্থান ভাণ্ডীরবন নামে অভিহিত হইয়াছে।

বোলপুরের অদূরবর্ত্তী সুপুর গ্রামে সুরথ রাজার পূজিত বলিয়া নির্দ্দেশিত সুরথেশ্বর শিব এখনও বোলপুর-ইলামবাজার রাস্তার উপর বিদ্যমান আছেন। কথিত আছে যে সুরথ রাজা ভগবতী সুভিক্ষাদেবীর নিকট লক্ষ বলিপ্রদান করেন। যে স্থলে এই বলি প্রদত্ত হয়, তাহা ‘বলিপুর’ হইতে হইতে অধুনা বোলপুর নামে খ্যাত হইয়াছে।
মল্লারপুর ষ্টেশনের পাঁচ মেইল পূর্ব্বে তারাপুর। কথিত আছে যে বশিষ্ঠ তারামন্ত্রে দীক্ষিত হইয়া বহু সাধনার পরও সিদ্ধিলাভ করিতে পারেন নাই। পরে, চীন প্রভৃতি নানা স্থান পরিভ্রমণপূর্ব্বক কামরূপ হইতে তারাদেবীকে আনয়ন করিয়া এই তারাপুর বা চণ্ডীপুরে উচ্চ স্থানে স্থাপন করেন এবং উত্তরবাহিনী দ্বারকা নদীর পূর্ব্বতীরে আশ্রম নির্ম্মাণ করিয়া অনেক দুঃসাধ্য সাধনার পর তারাদেবীর আরাধনা করিয়া সিদ্ধিলাভ করেন। এই স্থানে উল্লেখযোগ্য যে এই বশিষ্ঠ, রঘুকুলগুরু বশিষ্ঠ বা বশিষ্ঠবংশীয় অপর কোন প্রাচীনতর পৌরাণিক যুগের বশিষ্ঠ নহেন। এক নামের যে সকল বশিষ্ঠ, বিশ্বামিত্র, ভৃগু প্রভৃতি ঋষির উল্লেখ আছে, তাঁহারা সকলেই এক ব্যক্তি নহেন। তাঁহারা স্ব স্ব গোত্রনামে পরিচিত হইতেন বলিয়া এইরূপ গোলযোগের সৃষ্টি হইয়াছে।
মল্লারপুর ষ্টেশনের অদূরেই মল্লারপুর গ্রামের পূর্ব্বাংশ শিব-পাহাড়ী নামে একটি পাহাড় আছে। কথিত আছে যে দ্রৌপদী হরণ করিবার অভিলাষে সিন্ধুপতি জয়দ্রথ কাম্যকবনে গমন করিলে, তিনি ভীম কর্ত্তৃক বিশেষরূপে লাঞ্ছিত হন। তাহার পর তিনি এই স্থানে আসিয়া মল্লেশ্বর শিব ‘সিদ্ধনাথের’ আরাধনা করেন।
সাঁইথিয়ার পাঁচ মেইল পূর্ব্বে অবস্থিত কোটাসুর (অসুরের কোষ্ঠ বা কোঠা) মাহাভারতোক্ত হিড়িম্ব ও বকাসুর নামক অসুরের আবাসভূমি বলিয়া নির্দ্দেশিত হয়। কথিত আছে যে, এই বকাসুর ভীম কর্ত্তৃক নিহত হয়।
নলহাটি পাহাড়ে পার্ব্বতী মন্দিরের অদূরে একটি প্রস্তর খণ্ডে দুইটি পদ-চিহ্ন অঙ্কিত দেখা যায়। সাধারণ লোকে, এই পদচিহ্ন দুইটি সীতাদেবীর পদচিহ্ন বলিয়া পূজা করিয়া থাকে।
নলহাটি-আজিমগঞ্জ রেল লাইনের লোহাপুর ষ্টেশনের উত্তরে গম্ভীরা নদীতীরে বারা বা বালানগর নামে একটি গণ্ডগ্রাম আছে। এতদঞ্চলে প্রবাদ এই যে – এই বারা বাণ রাজার রাজধানী ছিল। আবার কাহারও মতে – বালা রাজার রাজধানী ছিল বলিয়া ইহার নাম বালানগর। অনেকেই বলেন যে বারা ও তাহার নিকটবর্ত্তী নগরা ও বাণেশ্বর এই তিন গ্রামের অধিকৃত অঞ্চল মহাভারতোক্ত বারণাবত নগর। এই স্থানেই পাণ্ডবগণ জতুগৃহ দাহ করিয়া একচক্রায় বা বর্ত্তমান মৌড়েশ্বর ও বীরচন্দ্রপুর প্রভৃতি অঞ্চলে চলিয়া আসেন এবং তথায় বকরাক্ষসাদি বধ করেন। পঞ্চপাণ্ডবের নামানুসারে পঞ্চগ্রামের (পাণ্ডবতলা) নামকরণ হইয়াছে। যুধিষ্ঠিরাদি পঞ্চপাণ্ডব কিয়ৎকাল এই অঞ্চলে অজ্ঞাতবাস করিয়াছিলেন, এইরূপ জনশ্রুতি আছে।
বীরভূম জেলার উত্তর সীমান্তে রাজগাঁ ষ্টেশনের প্রায় দুই ক্রোশ পশ্চিমে প্রাচীন অট্টালিকার ধ্বংসাবশেষ বিশিষ্ট বীরনগর নামে একটি ক্ষুদ্র স্থান আছে। ইহারই নিকটে সীতাপাহাড়ী নামক লতাগুল্ম সমাচ্ছাদিত একটি ক্ষুদ্র পাহাড় দেখিতে পাওয়া যায়। এই পাহাড়ে দুইটি গুহা আছে। প্রবাদ এই যে – বনবাসকালে শ্রীরামচন্দ্র ও সীতাদেবী এতদঞ্চলে আগমন করিয়াছিলেন। আবার, বীরনগর হইতে প্রায় চারি ক্রোশ দূরে সীতাপাহাড়ী নামে একখানি গ্রাম আছে। গ্রামের নিকটেই একটি ক্ষুদ্র পাহাড়ে পাথরের চুল্লী আছে। প্রবাদ যে, বনবাসকালে সীতাদেবী তথায় রন্ধন করিয়াছিলেন। এই স্থানে তিনি শ্রীরামচন্দ্রের সহিত যে প্রস্তরে বসিয়া ক্রীড়া করিতেন, লোকে তাহারও চিহ্ন দেখাইয়া থাকে।
(গৌরীহর মিত্র রচিত ‘বীরভূমের ইতিহাস’ গ্রন্থ থেকে সংকলিত, সম্পাদনা-পার্থ শঙ্খ মজুমদার, আশাদীপ প্রকাশনা)