কলকাতায় কেক-পেস্ট্রিতে সমুদ্রের স্বাদ বুনছে বুড়ো সালদানা

শীত এসেছে কলকাতায়। কলকাতার শীত বরফের দেশের মতো সাদা নয়। উত্তুরে হাওয়া হিমের কুচি উড়িয়ে আনে না। কলকাতায় শীত মানে রং। হলদে, কমলা, গোলাপি, সবুজ, নীল রঙের পাতলা স্কার্ফ, স্টোল উড়তে থাকে ফুরফুরে হাওয়ায়। গড়িয়াহাট, নিউমার্কেট জুড়ে শীতের ধোঁয়াটে সন্ধ্যায় আলো হয়ে থাকে সেইসব রঙেরা। শীতকালে কলকাতার বয়স কমে। চারদিকে মেলা, পিকনিকের চিঠি আসে। আর আসে কেক-পেস্ট্রির গন্ধ। এই শহরে বাহারি কেকের ঠেক এমনিতে কম নেই। আর, এখন তো বাড়িতে বসেও দিব্বি বানানো যায় কেক। কিন্তু, এই সহজলভ্যতার পাশাপাশিই কলকাতায় আজো লুকিয়ে আছে কয়েকটি বেকারির গুপ্ত ভাণ্ডার। সাবেক কলকাতার ইতিহাস, কেক তৈরির গন্ধরা মিলেমিশে একজোট সেখানে।
তেমনই গন্ধের হদিশ নিতে পৌঁছে যাওয়া সালদানা বেকারির গলিতে। গোয়ানিজ বেকারি এই সালদানা। সমুদ্রপাড়ের দেশ থেকে এসে কলকাতাকে কেক-পেস্ট্রির স্বাদে বুঁদ করা শুরু হয়েছিল স্বাধীনতারও আগে। নাম শুনেছিলাম আগেই। ইতিহাসের মতোই খুঁজে নিতে হয় এইসব জায়গা। খুঁজতে-খুঁজতেই ঘুরপথে বেঁকে যেতে হয় মাঝেমাঝে। এসপ্ল্যানেড মেট্রোস্টেশনে নেমে লেনিন সরণি থেকে অটো। সেখান থেকে শেক্সপীয়র সরণি ঘুরে রিপণ স্ট্রিটের ত্রিকোণ পার্কের মুখোমুখি নামা। পথে চোখে পড়ল বড়োদিনের প্রস্তুতি। দোকানে দোকানে ক্রিস্টমাস ট্রি, তাতে আবার সাদা ঝুরো বরফ... উৎসব ডাক পাঠাচ্ছে ব্যস্ত শহরকে।
রিপন স্ট্রিট থেকে পায়ে হেঁটে ১৯, আবদুর রাহমান স্ট্রিট। খানিক অন্ধকার গলিপথ, পুরোনো কোঠা, অলিন্দ, গলির মাথায় সাজানো নিশান পেরিয়ে সালদানা বেকারি। ঢুকতেই হলদে দেওয়ালে লেখা তার নাম। ডানদিকে হাতে হাতে কাজ করছে জনা দশেক মানুষ। বেকিং চলছে। পাহাড়ের মতো উঁচু হয়ে রয়েছে ময়দা। সামনেই বড়োদিন, তার অর্ডার আসছে মুহুর্মুহু। সালদানা বেকারির মানুষজনের তাই কাজের অন্ত নেই। ভর সন্ধেবেলা অত কাজের মধ্যেও কিন্তু হাসিটুকু লেগেছিল মানুষগুলোর ঠোঁটে। তাঁদের দক্ষযজ্ঞ হাঁ করে দেখছি। একমুখ হেসে আপ্যায়ন জানালেন তাঁরা। এমন সুযোগ ছাড়তে নেই। ভেতরে ঢুকে পড়ে কেক তৈরি হওয়া দেখে নিলাম খানিক।
বেকারি। ওবেলিনার ছেলে, পেশায় যে চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্ট, চাকরি ছেড়ে বেছে নেয় কেক তৈরির কাজ। তারই মেয়ে ডেব্রা। সে আবার পেশায় ব্যাংককর্মী। কিন্তু, পারিবারিক এই ব্যবসাতেই তাঁর সময় কাটে। সঙ্গে অবশ্য সে পায় মেয়ে আলিশাকে। ডেব্রার বাবার সঙ্গেও দেখা হয় আমাদের। চেককাটা লুঙ্গির ওপর সাদা জামা, তার ওপর হাফ-হাতা সোয়েটার, নাকে চশমা এঁটে ঘুরে বেড়ানো থুত্থুরে বুড়ো। কিন্তু বয়স হলেই বা কী? কে আসছে, যাচ্ছে, খদ্দের ঠিক মতো কেক পেল কিনা, কেকের মান বজায় থাকছে কিনা, সব দিকেই তাঁর কড়া নজর।
গোয়ান এই পরিবারটি আজও বজায় রেখে চলেছে কলকাতায় হাতে তৈরি কেকের ট্রাডিশন। ফ্রুট কেক, ওয়ালনাট, চকোলেট কেক, ম্যাকারুন টার্ট, ফ্রেঞ্চ ম্যাকারুন, ক্রিম রোল, চিকেন প্যাটিস, এনভেলপ, চিজ স্ট্যস, স্যান্ডুইচ, গার্লিক ব্রেড-- হাজারও পসরা তাদের। রয়েছে সুস্বাদু ডেজার্ট। এছাড়া যেকোনো উৎসবে সালদানার কেক লাজবাব। জন্মদিন, বড়োদিন তো বটেই। খ্রিস্টান বিয়ের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ কেক। সালদানার তাতে দেশজোড়া সুনাম। বিলাসপুর, বিহার, উত্তরপ্রদেশে পৌঁছে যায় তাদের কেক।
বেকারির কর্মচারী থেকে খরিদ্দার, সকলের কাছেই ডেব্রা-- আন্টি। যে আসে, তারা সবাই যেন ডেব্রার ঢের চেনা। কলকাতায় বড়ো বড়ো শীতাতপ-নিয়ন্ত্রিত দোকানে, কাচের দরজা ঠেলে ঢুকে দু-তিনটি শব্দ বিনিময়ে বেচাকেনা চলে। সেখানে হাজার-রকম জিনিস মিললেও এই আন্তরিকতার বড্ড অভাব। আর সালদানায় ঢোকা ইস্তক কথায় হাসিতে হট্টগোলে কেমন মায়া পড়ে যায়। বিক্রেতা ও ক্রেতার সম্পর্ক এখানে মেকি কিছু শব্দবন্ধ নয়।
নিজের চোখেই দেখলাম, অনবরত খদ্দের আসছে সালদানায়। অর্ডার আসছে। তারই মাঝে কেক চেখে দেখার আবদার করলেও হাসিমুখে তা মেটাচ্ছেন ডেব্রা। ফাইবারের প্লেটে চলে আসছে সালদানার বিখ্যাত ম্যাকারুন টার্ট বা ওয়ালনাট কেকের স্লাইস। মুখে দিতে না দিতেই গলে যাচ্ছে। কেক চাখতে চাখতেই বুঝতে পারলাম কেন সালদানার এমন অর্ডারের ভিড় লেগে আজো। এমন গলির মধ্যে ঠেক, বসার ব্যবস্থা নেই, চকচকে মোড়ক নেই, তুমুল বিজ্ঞাপন নেই, এমনকি নাহুমস-এর মতো নিউমার্কেটের ফুসফুসে একখানা বড় দোকানও নেই। চারপাশের হাল ফ্যাশনের ঝঁ চকচকে কেক-পেস্ট্রি শপের মধ্যে আশি বছরের বৃদ্ধ সালদানা তো বেমানান। তবু, ভিড় হয়। দক্ষিণ কলকাতার অফিস সেরে বরানগরের বাড়ি ফেরার পথেও সালদানায় এসে কেক কিনে নিয়ে যান চাকুরিজীবী। অ্যাংলো ফ্রেড, ক্লারা বিয়ের কেক কিনতে আসে। সময় কম, তবু কেক বানিয়ে দিতেই হবে। সালদানার কেক না হলে চলবে না।
এই গোটা আবহের সঙ্গেই যেন মিশে থাকে ডেব্রার আন্তরিক ব্যবহার, সদাহাস্য মুখ। মিশে থাকে অর্ডারের কেক কেনার পর টেস্ট করা স্লাইস কেকের দাম কিছুতেই নিতে না চাওয়া। গেস্টকে কেক খাওয়ানোর মূল্য তিনি নেন না। এত সহজেও আতিথ্য বুনে নেওয়া যায় বিকিকিনির বাজারে! আতিথ্য, আভিজাত্য, আন্তরিকতা আর অসামান্য স্বাদ--- সালদানার মায়া চিরতরে জড়িয়ে নেবেই।
সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে মুখ ফিরিয়ে বারবার বললাম, নিশ্চিত আসব আবার। বন্ধুবান্ধব সঙ্গে নিয়ে। ডেব্রার হাসিমুখ– “এনিটাইম ডিয়ার...”