হিমালয়ের সাত হাজার ফিট উঁচুতে ৭৪ কিমি দৌড়

আফ্রিকার রানাররা বলে দৌড় হওয়া উচিৎ সঠিক গতিতে আর আমেরিকা ও ইউরোপের রানাররা বলে দৌড় হওয়া উচিৎ সঠিক দূরত্বে।
আমার ইচ্ছে ছিল দুটোই পরীক্ষা করার। তাই ম্যারাথনে আমার সঠিক গতি ঝালিয়ে নেওয়ার পরে ঠিক করলাম, এবার দূরত্বের পরীক্ষা করা যাক। ম্যারাথন হয় ৪২.১২৪ কিমির, এর থেকে বেশি দূরত্বের যে কোনও দৌড়ের প্রতিযোগিতাকে বলা হয় আল্ট্রা ম্যারাথন। কলকাতা ম্যারাথনের দুই সপ্তাহের মধ্যেই নামলাম গাড়োয়াল রান-এ।
গাড়োয়াল রান শুরু হয় দেরাদুন শহর থেকে। তারপর ৭৪ কিমি পেরিয়ে ৭৩০০ ফুট উচু পাহাড় টপকে ধানুটি টপে গিয়ে এই রেস শেষ হয়। মানে, ম্যারাথনের চাইতেও প্রায় ৩০ কিমি বেশি দূরত্বের দৌড়, তাও আবার ৭০০০ ফুটের বেশি উচ্চতায়। দৌড় শুরুর আগে কোনও ধারণাই করতে পারছিলাম না, কীভাবে একটা আল্ট্রা ম্যারাথন শেষ করতে হয়। ঠিক কতটা কষ্ট হয়। সম্বল বলতে, শুধু ম্যারাথন শেষ করার কনফিডেন্সটুকু।
ভোর ছটায় শুরু হল দৌড়। ফেব্রুয়ারির শীতের সকাল, তখনও ঘুটঘুটে অন্ধকার। মাথায় হেডটর্চ লাগিয়ে দৌড় শুরু হল। আশেপাশে সকলেই বেশ অভিজ্ঞ রানার, কেউ জোরে কেউ আস্তে দৌড় শুরু করল। প্রথম ছয় কিমি ছিল সমতল, পুরো সাহস নিয়ে নিজস্ব গতিতে দৌড়ালাম, শেষ করলাম ২৫ মিনিটে। তারপর শুরু হল চড়াই, গতি ধরে রাখতে গিয়ে প্রচন্ড হাঁসফাঁস শুরু করলাম। বাধ্য হয়ে গতি কমালাম। এতক্ষণে যে চারজন লিড নিচ্ছিলাম, সেখান থেকে আমি বাদে বাকিরা এগিয়ে গেল। মুগ্ধ হয়ে চড়াইতেও ওদের স্পিড দেখছিলাম। যে তিনজন আমাকে ছাড়িয়ে এগিয়ে গেল, তাদের মধ্যে একজন মহিলা রানারও ছিল।
আমি ধীরে ধীরে আমার নিজস্ব ছন্দে এগোতে শুরু করলাম। রাস্তা প্রচন্ড চড়াই, ধীরে ধীরে ভোরের আলো ফুটছে, নীচে দেরাদুন শহর ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে উঠছে, সামনে পেছনে কোনও রানার দেখতে পাচ্ছি না, বুঝলাম একাই পেরোতে হবে। ২১ কিমি শেষ করলাম ২ ঘন্টা ১০ মিনিটে, তারপর সেই চড়াই চললো ৩৪ কিমি অবধি। এরপর শুরু হল উৎরাই। এবার ইচ্ছেমতো গতি বাড়ালাম।
এই সময় কোথা থেকে একটা কুকুর এসে পায়ে কামড় বসালো। কলকাতাতেও ভোরে দৌড়োতে বেরোলে এরকম কুকুর তাড়া করে। কিন্তু, কামড় বসানোটা আকস্মিক। তবে দৌড়োতে গিয়ে পায়ের পেশি এতটাই শক্ত হয়ে গিয়েছিল, পায়ে দাঁত ফোটাতে পারেনি।
প্রায় পৌনে পাঁচ ঘন্টায় ৪২ কিমি অর্থাৎ ম্যারাথনের দূরত্ব শেষ করলাম। আর তারপরেই মানসিক আর শারীরিকভাবে ভেঙে পড়লাম। কী করে বাকি দূরত্ব শেষ করব বুঝতে পারছিলাম না। মাথা ঘুরছে, রাস্তার ধারে বসেই পড়লাম। তখনও চতুর্থ স্থানেই রয়েছি, কিন্তু বুঝলাম আমি শেষ। কয়েক মিনিট পরেই পরের রানাররা একে একে পেরতে লাগলো, আর আমায় আবার দৌড়ানোর জন্য উৎসাহ দিতে লাগলো। সাহস নিয়ে উঠে দাড়ালাম, জানতাম ৪৭ কিমি অবধি উৎরাই। সেটা কোনওক্রমে পেরোলাম সাড়ে পাঁচ ঘন্টায়। আর, তারপরেই দৌড়োনো বন্ধ করে পুরোপুরি হাঁটা শুরু করলাম। আমার টার্গেট ছিল ১১ ঘন্টায় গাড়োয়াল রান শেষ করে পরের ধাপের জন্য কোয়ালিফাই করা। অর্থাৎ শেষ ২৭ কিমি চড়াইয়ের জন্য এখনও আমার হাতে সাড়ে পাঁচ ঘন্টা রয়েছে। কিন্তু শরীর মন সব বিধ্বস্ত। তাই, অগত্যা হাঁটাই শুরু করলাম।
যখন ৫৫ কিমি পেরোলাম, ততক্ষণে ৭ ঘন্টা ২০ মিনিট পেরিয়ে গিয়েছে। ফের হিসেব করলাম, এইভাবে হাঁটলে ১১ ঘন্টায় কোনওভাবেই পৌছাতে পারব না, আমাকে দৌড়ানো শুরু করতেই হবে।
কিন্তু কীভাবে আবার দৌড় শুরু করব, বুঝতেই পারছি না। আমার পা ব্যথাতে জমে গিয়েছে। হাঁটুও তুলতে পারছি না। ভালো করে জল খাচ্ছি, খাবার খাচ্ছি, আর জোরে হাঁটার চেষ্টা করছি।
দিনটা ছিল শনিবার, দুপুর দুটোর দিকে স্কুলে হাফ ছুটি হয়ে গিয়েছে। বাচ্চারা সবাই স্কুল থেকে ফিরছে আর আমাদের উৎসাহ দিচ্ছে। এমনই একদল বাচ্চা খালি পায়ে আমার সঙ্গে দৌড়োনোর চেষ্টা করল। ওদের উৎসাহ দিতে আমিও দৌড়োনো শুরু করলাম। বুঝলাম, পায়ে অনুভূতি থাকুক বা না থাকুক, হাঁটু তুলে মাটিতে মারতে হবে। কিছুটা দূর অবধি বাচ্চাগুলো আমার পাশে-পাশেই দৌড়োলো। তারপর ওদের বিদায় জানিয়ে আমি দৌড় চালিয়ে গেলাম।
৬০ কিমির পর রাস্তা আরও চড়াই হয়ে গেল। কোনওভাবেই আর যেন হাঁটতেও পারছি না। শুধু পায়ে নয়, হাত কাঁধ সব কিছু থামতে চাইছে। চোখ থেকে জল বেরিয়ে আসছে, শুধু কোনওক্রমে পা-টা চালিয়ে যাচ্ছি। জানতাম, যদি হাল ছেড়ে দিই, তাহলে আমি এই নৃশংস কষ্ট থেকে উদ্ধার পাব। আমার হারানোরও কিছু নেই। কিন্তু, যদি শেষ করতে পারি, জীবনের বড় অ্যাচিভমেন্ট হবে। এক বছর আগেও আমি পাঁচ কিমির বেশি দৌড়োতে পারতাম না। আর আজ ৭৪ কিমি শেষ করতে চলেছি।
৭০ কিমির পর শেষ ৪ কিমি ফের উৎরাই শুরু হল। শেষ চার কিমি সব কিছু ভুলে ফের নিজের পেস নিলাম, বুঝতে পারছিলাম না পা আছে না নেই, শরীর কীভাবে চলছে। শুধু পা চালিয়ে যাচ্ছিলাম।
৭৪ কিমি দূরত্ব, ৭৩০০ ফিট চড়াই শেষ করলাম ১০ ঘন্টা ২০ মিনিটে। এর আগে ম্যারাথন দৌড়ে বুঝেছিলাম একবার ভেঙে পড়লে ফের উঠে দাঁড়াতে হয়। আল্ট্রা দৌড়োতে গিয়ে বুঝলাম এখানে কতবার ভেঙে পড়ব ঠিক থাকে না, কিন্তু লক্ষ্য ঠিক থাকলে প্রতিবারই উঠে দাঁড়াতে হয়। হাল ধরে রাখতে হয়। এ যেন জীবনেরও একটা বড় শিক্ষা দিয়ে গেল।
এবার ঠিক করলাম এই আল্ট্রা ম্যারাথনের দূরত্ব শেষ করব কোনও ট্রেক রুটে।
(ক্রমশ)