“রাইফেলই ক্ষমতার উৎস”- শেখাচ্ছেন উৎপল দত্ত

১৯৬৭ সাল, নকশাল বাড়ির কৃষক সংগ্রামের একটি ঐতিহাসিক অধ্যায়। এই ঘটনাটিকে কেন্দ্র করে ভারতের কমিউনিস্ট আন্দোলনের মধ্যে ব্যাপক ভাঙন দেখা দেয়। যাঁরা নকশাল বাড়ির কৃষকদের সমর্থন করেছিলেন, তাঁরা চলে গিয়েছিলেন একদিকে। বাড়ির কৃষকদের দায় এসে পড়েছিল তৎকালীন মন্ত্রিসভার দায়িত্বে যাঁরা ছিলেন, তাঁদের উপরে। সেইসময় বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে স্পষ্ট হয়ে উঠছিল একটি বিভাজনরেখা। নাট্য আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা উৎপল দত্ত ছিলেন এই কৃষক আন্দোলনের সপক্ষে। তাঁর উদ্যোগেই লিটল থিয়েটার গ্রুপের মঞ্চে নকশাল বাড়ির কৃষকদের সমর্থনে একটি উৎসবের আয়োজন করা হয়। উৎসবের শুরুর দিন উৎপল দত্ত, সৃজন সেনের মতো কিছু ব্যক্তিরা মঞ্চে হাজির ছিলেন।
মঞ্চ সাজানোর প্রস্তুতি চলছে। উৎপল দত্ত হঠাৎ ভেবে বসলেন, মাও সে তুঙের বিখ্যাত একটি উক্তি দিয়েই চারদিক সাজানো হবে। মাওয়ের উক্তিটি ছিল, “প্রতিটি কমিউনিস্টকে অবশ্যই এ সত্য বুঝতে হবে যে, বন্দুকের নল থেকে রাজনৈতিক ক্ষমতা বেরিয়ে আসে”। আয়োজিত সভায় ঠিক করা হল মঞ্চের পিছনে কালো কাপড়ে কাগজ কেটে সেখানে লেখা থাকবে ‘বন্দুকের নল থেকেই রাজনৈতিক ক্ষমতা বেরিয়ে আসে।’ কিন্তু লিখতে গিয়ে দেখা গেল লেখাটা অনেক বড় হওয়ার দরুন পোস্টারে এক লাইনে লেখা যাচ্ছে না। সবাই মিলে ভাবতে বসলেন, এখন উপায় কী!
আরও পড়ুন
অশোক মিত্র : সুভদ্র বিদ্বান বিদ্রোহী
হঠাৎ একসময় উৎপল দত্ত চেঁচিয়ে উঠলেন, ‘ইউরেকা ইউরেকা’ বলে। উৎপলবাবুর মস্তিষ্কপ্রসূত ভাবনা থেকেই বেরিয়ে এল রাজনীতির একটি নতুন সুর, বলা ভালো শ্লোগান। তাঁর বুদ্ধিতেই লেখা হল ‘রাইফেলই ক্ষমতার উৎস।’ এই উক্তিই কালো কাপড়ের পিছনে লাগানো হল। সেকালের ছাত্রসমাজ এবং রাজনৈতিক সচেতন ব্যক্তিবর্গের মধ্যে তা নিয়ে রীতিমতো হইচই শুরু হয়ে গেল। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, কথাটির মধ্যে অর্ধেক সত্যি আছে। এর মর্মার্থ হল, যাদের হাতে বন্দুক অর্থাৎ সশস্ত্রবাহিনী থাকে তারাই ক্ষমতার নিয়ন্ত্রক। কিন্তু সেই ক্ষমতা হল রাজনীতির ক্ষমতা। রাইফেল তো গুণ্ডাদের হাতেও থাকে, চোর ডাকাতদের হাতেও থাকে। এখন প্রশ্ন হল, এই রাইফেলকে কারা বা কোন রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করছে। এই ছোট্ট একটা উক্তিই আন্দোলনের কাল হয়ে দাঁড়ায়। রাইফেলের চিন্তা করাটাই আন্দোলনের একটা বিষয় হয়ে দাঁড়াল এবং মানুষকে ভুল পথে চালিত করল।
১৯৬৭ সালের সেইদিনের কথা খুবই পরিচিতি লাভ করেছিল পরবর্তীকালে। এই বহুল ব্যবহৃত কথাটিই আমরা পরবর্তীকালে সাহিত্যের বিভিন্ন জায়গায় দেখতে পাব। রাইফেল বা বন্দুকের নলই ক্ষমতার উৎস- পথেঘাটে দেওয়ালে এই উক্তি রীতিমতো ভাইরাল হয়ে গিয়েছিল। এই ভুল বার্তার দায়িত্ব নিতে হয় ওই আন্দোলনকারীদেরই। উৎপল দত্ত যদিও পরবর্তীকালে আবার কমিউনিস্ট পার্টিতে ফিরে গিয়েছিলেন। নকশাল আন্দোলনও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে স্তিমিতপ্রায় হয়ে এসেছিল। আন্দোলনে নানান ভুলভ্রান্তি খুঁজে পাচ্ছিলেন অংশগ্রহণকারী কর্মীরাই। উৎপল দত্ত একজন স্বনামধন্য অভিনেতা, নাট্যকার এবং রাজনৈতিকভাবে সচেতন একজন মানুষ। এমন নানান ঘটনার ছবি ভেসে উঠবে উৎপলবাবুর সহকারী যোদ্ধা হিসাবে থাকা সৃজন সেনদের মতো ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে। স্মৃতিচারণায় তাঁরাও কি সেই ইতিহাসের কাছে ফিরে যান না! সেই উত্তাল আগুনধরা সময়ে! হয়ত যান, হয়ত কালের নিয়ম গ্রাস করে চশমার মোটা ফ্রেমে কিংবা কুঁচকে যাওয়া চামড়ায়।
সূত্র- সৃজন সেন