মংপুতে রবীন্দ্রনাথ

পাহাড়ের মংপুতে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর স্মৃতি বিজড়িত রবীন্দ্র ভবন এখন সুন্দর করে সাজিয়ে তোলার কাজ চলছে। আগামী পঁচিশে বৈশাখ সেই ঐতিহাসিক ভবন আবার নতুন করে পর্যটকদের জন্য খুলে দেওয়া হবে। প্রায় এক বছরেরও বেশি সময় ধরে সেখানে কাজ চলছে। মাঝখানে পাহাড়ের বন্ধ আর আগুন লাগানোর আন্দোলনের জেরে এই কাজ বন্ধ ছিল। কিন্তু এবারে জেলা প্রশাসন পঁচিশ বৈশাখের আগে কাজ শেষ করতে নির্দেশ দিয়েছে। সেই অনুযায়ী ৫ মে-র মধ্যে কাজ শেষ করে তা প্রশাসনের হাতে তুলে দেওয়ার প্রস্তুতি এখন জোর কদমে।
মূল ঐতিহাসিক কাঠামো ঠিক রেখে ওই ভবনের মেঝে সুন্দর করে তোলা হচ্ছে। ভিতরে বাইরে রং করা হচ্ছে। আগে বৃষ্টির সময় ভিতরে জল পড়ত। এখন যাতে তা না হয়, তার ব্যবস্থা হচ্ছে। হচ্ছে আরো অনেক কাজ। তবে অনেক দিন ধরে ওই ভবনের ভিতরে প্রবেশ পর্যটকদের নিষেধ। ফলে সবাই বাইরে থেকেই ভবনটি দেখে ফিরে আসছেন।
অথচ এই ভবনে বিশ্বকবিকে ঘিরে অনেক স্মৃতি জড়িয়ে আছে। ১৯৩৮ সালের ২১ মে কবি প্রথমবার কালিম্পং থেকে মংপু-র সুরেল বাংলোতে আসেন। সেখানে ৫ জুন পর্যন্ত কাটিয়ে তিনি এই ভবনে এসে ৯ জুন পর্যন্ত থাকেন। তারপর আবার চলে যান কালিম্পং। দ্বিতীয়বার কবি ১৯৩৯ সালের ১৪ মে পুরী থেকে সোজা মংপু আসেন গ্রীষ্ম কাটাতে। সেবারে ১৭ জুন পর্যন্ত সময় পার করে কবি কলকাতায় ফিরে যান। তারপর ওই বছরই সেপ্টেম্বর মাসের ১২ তারিখে তিনি আবার মংপুতে আসেন। দুই মাসের কিছু বেশি সময় পার করে নভেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহে কলকাতায় ফিরে যান। ১৯৪০ সালের ২১ এপ্রিল চতুর্থ বারের জন্য মংপু আসেন রবীন্দ্রনাথ। সেবারে পঁচিশে বৈশাখে তাঁর জন্মদিন সেখানেই পালিত হয়। সেখান থেকে তিনি কালিম্পং যান। সেই বছরই শরৎকালে আবার মংপু আসবেন বলে জিনিসপত্রও রেখে যান। কিন্তু আর মংপু আসা হয়নি। তিনি সেবারে শরৎকালে কালিম্পং আসেন। তখন তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। ফলে আর আসতে পারেননি মংপু। ২৮ সেপ্টেম্বর তিনি কালিম্পং-এর গৌরীপুরে অজ্ঞান হয়ে গেলে, তাকে কলকাতায় নিয়ে যাওয়া হয়।
কবি বার বার মংপুতে এসেছিলেন তাঁর একান্ত অনুগামী মৈত্রেয়ী দেবীর আমন্ত্রণে। লেখিকা এবং ঔপন্যাসিক হিসাবে পরিচিত মৈত্রেয়ী দেবী। মৈত্রেয়ী দেবীর বাবা সুরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত ছিলেন অধ্যাপক। সুরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্তের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বেশ ভালো সম্পর্ক ছিল। আর তার বাবার সঙ্গে বেশ কয়েকবার মৈত্রেয়েী দেবী বিশ্বকবির কাছে গিয়েছিলেন। মৈত্রেয়ী দেবীর বিয়ে হয়েছিল সিঙ্কোনা প্ল্যান্টেশনের চিফ কেমিস্ট মনমোহন সেনের সঙ্গে। সেই কাজের সুবাদে মৈত্রেয়ী দেবী থাকতেন স্বামীর কোয়ার্টারে। সেই কোয়ার্টারেই কবিকে বারবার আমন্ত্রণ জানিয়ে নিয়ে আসেন মৈত্রেয়ী দেবী। কবি সেখানকার শান্ত, সুন্দর পাহাড় দেখে মুগ্ধ হয়ে এক মাস, দেড় মাস করে থেকে যেতেন। সেই কোয়ার্টারটি সিঙ্কোনা মন্ত্রণালয়ের অধীনে আজ ঐতিহাসিক রবীন্দ্র ভবন। সেই ভবনে কবির ব্যবহার করা খাট, লেখার ডেস্ক, রঙের প্যালেট, বায়োকেমিক ওষুধের শিশি, বহু ছবি আজও রয়ে গিয়েছে। কবি এই ভবনে বসেই তাঁর ‘জন্মদিন’ কবিতা যেমন লিখেছেন, তেমনই শেষ কথা, বাংলা ভাষার পরিচয়, ছেলেবেলার কথা লিখেছেন। তাছাড়া নবজাতক, সানাই, আকাশ প্রদীপ, মংপু, ক্যামেলিয়া কবিতাগুলো এখানে বসেই লেখা। তিনি এখানে বসে পাহাড়ের ছবি বাদে বেশ কিছু ছবি নিজে হাতে এঁকেছেন। সেসব এখন এই ভবনের সংগ্রহশালায় রাখা আছে। মৈত্রেয়ী দেবিকে লেখা কবির কিছু চিঠিও এখানে শোভা পাচ্ছে।
আরও পড়ুন
পাহাড়ে গাড়ি চালিয়ে নজির গড়ছেন এই মহিলা
কবি কখনও সড়ক যোগে রম্ভি পর্যন্ত আসতেন। কখনও টয় ট্রেনে গেলিখোলা পর্যন্ত। তারপর রম্ভি থেকে ৯ কিলোমিটার পথ কবি পালকি করে আসতেন। ৩৭৫৯ ফুট উচ্চতায় মংপু এখন ছোট পাহাড়ি শহর, কবির সময় তা ছিল পাহাড়ি গণ্ডগ্রাম। সিঙ্কোনা চাষের জন্যই এর প্রথম খ্যাতি ছড়ায়। কালিম্পং থেকে এর দূরত্ব ৩৮ কিলোমিটার, দার্জিলিং থেকে দুরত্ব ৫৭ কিলোমিটার আর শিলিগুড়ি থেকে দুরত্ব ৪৭ কিলোমিটার। এর ১৩ কিলোমিটার নিচে শাল, সেগুন, অর্জুন সহ নানা গাছের সমারোহ। মংপু যাওয়ার পথে রাস্তার ধারে দিনের বেলাতেই যেন বনের ধার থেকে ঝি ঝি পোকার ডাক কানে ভেসে আসে। শিলিগুড়ি থেকে ৩১ নম্বর জাতীয় সড়ক ধরে রম্ভি থেকে এর দুরত্ব ৯ কিলোমিটার। বিভিন্ন ভাবে অবহেলায় কবির স্মৃতি বিজড়িত এই ভবন নষ্ট হতে বসেছিল।
এখন এর গুরুত্ব ও সৌন্দর্য বাড়ানোর প্রয়াস শুরু হয়েছে। মৈত্রেয়ী দেবীর মংপুতে রবীন্দ্রনাথ লেখায় কবির বিষয়ে বিস্তারিত সব বিবরণ আছে।