অযোধ্যার বনপাহাড়ি পথে ৮০কিমি দৌড়ের আসর

লালমাটি আর শালরাজার দেশ পুরুলিয়ার মুকুট যেন অযোধ্যা পাহাড়। ঢেউ খেলানো পাহাড়ের সারি। পাহাড়ের বুকে বন। ইতিউতি ছবির মতো সুন্দর গ্রাম। পাহাড়ের কোলে ধানখেত। মাঝেমাঝে ছোটো ছোটো পুকুর। আর এই গ্রাম, পুকুর, খেত ছুঁয়ে রাস্তাটা ঢুকে যাচ্ছে বনের ভিতরে, কখনো উঠে যাচ্ছে পাহাড়ের মাথায়। ফের ঢালুপথে নেমে এসে মিশছে বনে। টাঁড়পাহাড়ের দেশ অযোধ্যায় ওঠার কোনো পথই সোজা নয়।
এই লালমাটি, পাহাড়, বন ছুঁয়ে ছুঁয়েই এবার দৌড়বেন দূরপাল্লার দৌড়বিদরা। পথ কখনো চড়াই নেবে অনেকখানি, কখনো নেবে অনেকটা বাঁক। বনের ভিতর দিয়ে দৌড়তে দৌড়তেই হয়তো মহুয়া ফুলের কুঁড়ি চোখে পড়বে। আশপাশ দিয়ে উড়ে যাবে পাখির ঝাঁক। এইসব বনপথে আসার আগে রোদও গাছগাছালির অনুমতি চেয়ে নেয়।
অযোধ্যার এই পাহাড়ি পথেই বসছে একটানা ৮০ কিমি দৌড়ের আসর। দ্য বেঙ্গল আলট্রা রান। ১৭ ফেব্রুয়ারি পুরুলিয়ায় শুরু হবে পশ্চিমবঙ্গের এই প্রথম আলট্রা ম্যারাথনের দৌড়। ইভেন্টের ঢাকে কাঠি পড়বে অবশ্য তার আগের দিন, ১৬ ফেব্রুয়ারি। প্রতিযোগীরা সেদিন এসেই যোগ দেবেন ক্যাম্পে।
পোশাকি ভাষায় ৪২.১৯৫ কিমির চাইতে দীর্ঘ পথের যে কোনো দৌড়কেই বলে আলট্রা ম্যারাথন। অনেক আলট্রা ম্যারাথনেই দৌড়ের মাঝপথে রাত্রিযাপনের অবকাশ থাকে। দ্য বেঙ্গল আলট্রা রানে এই সুযোগ নেই। অর্থাৎ ৮০ কিমি পেরতে হবে একবারেই। এবং, অযোধ্যার পাহাড়ি পথে এই দৌড় শুধুই আলট্রা ম্যারাথন নয়, ট্রেল রানও। ট্রেল রান বলতে বোঝায় অসমতল পাহাড়ি পথ ধরে, চড়াই-উতরাই ভেঙে দৌড়নো। সমতলের ম্যারাথনের চাইতে ট্রেল রানে চ্যালেঞ্জ ও অ্যাডভেঞ্চার অনেক বেশি। উচ্চতা এবং পথের দুর্গমতা—দুই কারণেই। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে অযোধ্যা পাহাড়ের উচ্চতাও নেহাত কম নয়। পথে চড়াই আছে ভালোই। এমন পথে ৮০ কিমি দৌড় যে কোনো ট্রেল রানারের দক্ষতারই পরীক্ষা নেবে, সন্দেহ নেই।
‘দ্য বেঙ্গল আলট্রা’র শুরুটা হয়েছিল অবশ্য গতবছর। সৈকত দত্ত ছিলেন মূল উদ্যোক্তা। সৈকত, নীলাঞ্জন লাহিড়ী এবং নীলেন্দু লাল মুখার্জীর মতো কয়েকজন ট্রেল রানার এবং অ্যাডভেঞ্চার-প্রিয় মানুষ মিলে ঠিক করেন আলট্রা ম্যারাথন এবং ট্রেল রানের মানচিত্রে পুরুলিয়াকেও যুক্ত করতে হবে। অযোধ্যা পাহাড়ের নানা অংশ এখনো অনাবিষ্কৃত। প্রকৃতি সেখানে আজো আদিম ও কুমারী। ট্রেল রানের প্রেক্ষাপট হিসেবে এই পুরুলিয়ার নিসর্গ, প্রকৃতিকে জুড়ে দেওয়ার লোভ এড়ানো সত্যিই কঠিন। পরিকল্পনা অনুযায়ী তোড়জোড় শুরু হল। সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিলেন সুদীপ ঘোষ, নিশান্ত মাহেশ্বরীর মতো আরো কয়েকজন। ১৭ ও ১৮ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত হল এই রাজ্যের প্রথম আলট্রা ম্যারাথন ও ট্রেল রানের ইভেন্ট। নতুন দৌড়বিদ ও অভিজ্ঞ ট্রেল রানারদের কথা মাথায় রেখে দৌড়কে দূরত্ব অনুযায়ী ভাঙা হয়েছিল তিনটি ভাগে— ১০ কিমি, ২৫ কিমি এবং ৫০ কিমি। প্রথম বছরেই বিপুল সাড়া পেয়েছিলেন উদ্যোক্তারা। এই ম্যারাথনের উদ্যোগে জড়িয়ে গিয়েছিলেন স্থানীয় গ্রামবাসীরাও। সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন উদ্যোক্তা ও প্রতিযোগীদের দিকে। দৌড়ের পর গ্রামের ভিতরেই ক্যাম্প, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, ছৌ নাচের আসর— সব মিলিয়ে এক অন্য জগৎ তৈরি হয়েছিল। তবে, প্রতিযোগীদের কাছে সবচাইতে বেশি জনপ্রিয়তা পেয়েছিল পোড়ামাটি, ছাই দিয়ে তৈরি আলট্রা ম্যারাথনে অংশগ্রহণের স্মারক মেডেলটি। নিছক স্মারক হিসেবে নয়, হস্তশিল্পের সামগ্রী হিসেবেও মেডেলটি ছিল চমকপ্রদ।
প্রথমবারের সাফল্যের পর এইবারের আলট্রা রানের ইভেন্ট বহরে আরো খানিক বড়ো হয়েছে। দূরত্বের ভাগগুলিও বেড়ে হয়েছে যথাক্রমে ২৫ কিমি, ৫০ কিমি এবং ৮০ কিমি। প্রথম স্তরটি স্বাভাবিকভাবেই নবাগতদের জন্য। একটানা ৮০ কিমি দৌড়, তাও পাহাড়ি রাস্তায়—দৌড়বিদদের কাছে চ্যালেঞ্জটি নেহাত কম নয়।
আন্তর্জাতিক ট্রেল রানিং অ্যাসোসিয়েশনের স্বীকৃতিও পেয়েছে পুরুলিয়ার এই দ্য বেঙ্গল আলট্রা রান। ৫০ কিমি শেষ করার জন্য ২ পয়েন্ট আর ৮০ কিমির জন্য ৩ পয়েন্ট মিলবে প্রতিযোগীদের। নানা আন্তর্জাতিক ট্রেল রানে অংশগ্রহণের জন্য এই আইটিআরএ নম্বর খুবই গুরুত্বপূর্ণ। উদ্যোক্তাদের বক্তব্য-- বাংলাদেশ, নেপাল-সহ বিদেশের অন্যান্য প্রান্ত থেকেও প্রতিযোগীরা অংশগ্রহণ করবেন এবারের দৌড়ে। তাছাড়া, দেশীয় দৌড়বিদরা তো আছেনই। প্রতিযোগীদের রেজিস্ট্রেশন শুরু হয়ে গেছে ইতিমধ্যেই।
জঙ্গলে ঘেরা কোঁকড়া চুলের মাথা নিয়ে অযোধ্যার পাহাড়, বনপথ, গ্রাম এখন অপেক্ষা করে আছে এই ইভেন্টের জন্য। যেখানে চড়াই ভেঙে ৮০ কিমি শেষ করার জন্য দৌড়বেন দেশ-বিদেশের দৌড়বিদরা। তাঁদের শ্রান্তিতে প্রলেপ বুলিয়ে দেবে অযোধ্যার নিসর্গ। প্রতি ৪-৫ কিমি অন্তর অন্তর জল, খাবার, ওষুধ নিয়ে উপস্থিত থাকবে ক্যাম্পও। আর, দৌড়ের পর গ্রামের ভিতরেই জমবে গান, লোকনাচের আসর।
ট্রেল রান আর আলট্রা ম্যারাথনের পরিচিত দুনিয়াতেও এক অন্য স্বাদ বুনে দিচ্ছে বাংলার এই লালমাটির দেশ।