No Image

   

00:00
00:00
Volume

 0 Songs

    চৌঠা নভেম্বর

    চৌঠা নভেম্বর

    Story image

    আমাদের দেশে ঋত্বিক নামে এক মানুষ ছিল 
    আমাদের দেশে ঋত্বিক নামে এক শিল্পী ছিল

    তিতাস একটি নদীর নাম (১৯৭৩)

    লোকটা আমাদের দেশে জন্মেছিল  
    লোকটা এক বার বাড়ি থেকে পালিয়েছিল 
    লোকটা খুউব ভালোবাসতে জানত  
    লোকটা পদ্মার ওপর দিয়ে বাংলাদেশ যাবার সময় হাউ হাউ করে কেঁদে ফেলেছিল 
    লোকটা ভালো ছবি আঁকতে জানত 
    লোকটা ভালো বাঁশি বাজাতে পারত 

    রাদেভুঁ (১৯৬৫)

    লোকটা তিনটে  উপন্যাস / বড়ো-গল্প লিখেছিল 
    (অয়নান্ত, আকাশগঙ্গার পথ বেয়ে, কোমল গান্ধার) 
    লোকটা ষোলোটা গল্প লিখেছিল 
    (আকাশগঙ্গার স্রোত ধরে, এজাহার, শিখা, এক্সট্যাসি, রূপকথা, রাজা, পরশপাথর, ভূস্বর্গ অচঞ্চল, স্ফটিকপাত্র, চোখ, কমরেড, সড়ক, প্রেম, ঝংকার, মার, গাছ)
    লোকটা দুটো কবিতা লিখেছিল 
    (আমাদের ফেলো না, বুকটা দুফালি করে) 
    লোকটা তিয়াত্তরটি প্রবন্ধ লিখেছিল 
    (গ্রন্থিত ছেষট্টিটি, অগ্রন্থিত এখনও সাতটি) 
    লোকটা একটা গ্রন্থ লিখে ছিল তাতে পনেরটি প্রবন্ধ ছিল 
    (চলচ্চিত্র মানুষ এবং আরও কিছু)
    লোকটা এক জন অভিনেতা ছিল 
    (নাটক বিসর্জন ইত্যাদি, সিনেমা ছিন্নমূল ও তথাপি, তিতাস একটি নদীর নাম, কুমারী মন, সুবর্ণরেখা, যুক্তি তক্কো আর গপ্পো)
    লোকটা সুপারহিট হিন্দি ছবির চিত্রনাট্য লিখতে জানত কিন্তু সেসব না করে বাংলায় ফিরে এসেছিল(মধুমতী )
    লোকটা অন্য পরিচালকদের জন্যে ছ-টি চিত্রনাট্য লিখেছিল 
    (মুসাফির, মধুমতী, স্বরলিপি, কুমারী মন, দ্বীপের নাম টীয়ারঙ)
    লোকটার যেসব চিত্রনাট্যের খসড়া শেষ হয়নি 
    (অকাল বসন্ত, অমৃতকুম্ভের সন্ধানে, আর্জান সর্দার, বলিদান, আরণ্যক, শ্যাম সে নেহা লাগেই, পদ্মানদীর মাঝি, নতুন ফসল)
    লোকটা পাঁচটা চিত্রনাট্যের  খসড়া লিখেছিল 
    (রাজা, সেই বিষ্ণুপ্রিয়া, প্রিন্সেস কলাবতী, লজ্জা, জন্মভূমি)

    সুবর্ণরেখা (১৯৬২)

    লোকটা দেশজ ঐতিহ্য, ইতিহাস,সংস্কৃতি এবং নিজের সময় নিয়ে কাজ করেছিল 
    লোকটা দেশভাগ, দাঙ্গা, দেশভাগ-পরবর্তী সময়, নকশাল আন্দোলন নিয়ে কাজ করেছিল 
    লোকটা আপাদমস্তক প্রতিষ্ঠান বিরোধী ছিল  
    লোকটা নাম যশ অর্থ খ্যাতির লোভ ত্যাগ করে শিল্পকাজ করতে পেরেছিল 
    লোকটা তার শিল্পীসত্তাকে কোনো দিন বাজারের শর্তে বিক্রি করেনি 
    লোকটা ফিল্মের তথাকথিত ল্যাংগোয়েজ কে পাত্তা দেয়নি, উলটে নতুন-ভাষা সন্ধান করে ছিল, সৃষ্টি করেছিল 

    যুক্তি তক্কো আর গপ্পো (১৯৭৪)

    লোকটা আটটি কাহিনিচিত্র সম্পূর্ণ করতে পেরেছিল 
    (নাগরিক, অযান্ত্রিক, বাড়ি থেকে পালিয়ে, মেঘে ঢাকা তারা, কোমল গান্ধার, সুবর্ণরেখা, তিতাস একটি নদীর নাম, যুক্তি তক্কো আর গপ্পো)
    লোকটা চারটে কাহিনিচিত্র শেষ করতে পারেনি 
    (নাগিনি কন্যার কাহিনি / বেদেনি / অরূপকথা, কত অজানারে, বগলার বঙ্গদর্শন, রঙের গোলাম)  
    লোকটা সাতটি তথ্যচিত্রের কাজ শেষ করতে পেরেছিল 
    (আদিবাসীওঁ কা জীবনস্রোত, বিহার কে দর্শণীয় স্থান, ওরাওঁ, ওস্তাদ আলাউদ্দীন খান, সায়েন্টিটস অফ টুমরো, পুরুলিয়ার ছৌ, আমার লেনিন) 
    লোকটা দুটো তথ্যচিত্র শেষ করতে পারেনি 
    (ইন্দিরা গান্ধী, রামকিঙ্কর)
    লোকটা চারটি স্বল্পদৈর্ঘ্যের চলচ্চিত্র তৈরি করতে পেরেছিল 
    (ফিয়ার, রাঁদেভু, ইয়ে কিঁউ, দুর্বার গতি পদ্মা) 
    লোকটা একটা বিজ্ঞাপন চিত্র তৈরি করেছিল  (সিজারস)

    অযান্ত্রিক(১৯৫৭-৫৮)

    লোকটা গণনাট্য আন্দোলনের এক জন অন্যতম ব্যক্তিত্ব ছিল 
    লোকটা এগারোটি (গ্রন্থিত সাত, অগ্রন্থিত চার) নাটক লিখেছিল 
    (ইস্পাত, কত ধানে কত চাল, কালো সায়র, জ্বলন্ত , জ্বালা, ঢেঁকি স্বর্গে গেলেও ধান ভাঙে, দলিল, নেতাজিকে নিয়ে, সাঁকো, সেই মেয়ে। 
    লোকটা সব মিলিয়ে  পঁয়ত্রিশটা নাটকে  কাজ করেছিল 
    লোকটা সাতটি নাটক প্রযোজনা ও পরিচালনা করেছিল  
    ( ভাঙা বন্দর, দলিল, বিসর্জন, অফিসার দু-বার, সুরজ এবং মুসাফিরোঁকে লিয়ে) 
    লোকটা তিনটে  বেতার নাটক প্রযোজনা ও পরিচালনা করেছিল 
    (কালো সায়র, মা, জ্বালা ) 
    লোকটা নাটকের কাগজ করত 
    (নির্মল দত্ত ও অমরেশ লাহিড়ির সঙ্গে রাজশাহী থেকে অভিধারা পত্রিকা ও একার দায়িত্বে অভিনয় দর্পণ কলকাতা থেকে) 
    লোকটা নাটকের কাগজে আটখানা সম্পাদকীয় লিখেছিল 
    (অভিনয় দর্পণ – আমাদের কথা)
    লোকটা নাটক নিয়ে কমপক্ষে নয়টা প্রবন্ধ লিখেছিল 
    লোকটা পাগলা গারদে গিয়ে ছিল 
    লোকটা সেখানেও নাটক করে ছিল  
    লোকটা বিনয় মজুমদারের কবিতা ভালোবেসেছিল 
    লোকটা সতরঞ্চি পেতে চাঁদা তুলে সিনেমা বানিয়ে ছিল (নাগরিক) 

    লোকটা ফিল্ম ইন্সটিউট অফ ইন্ডিয়ার উপাধ্যক্ষ ছিল 
    লোকটা  দেশের গর্ব এমন ছাত্র তৈরি করতে পেরেছিল 
    (মণি কউল, কুমার সাহনী, কে টি জন, ভাস্কর চন্দ্রভারকর)
    লোকটা কমিউনিস্ট পার্টি করেছিল 
    লোকটা পার্টির মূল লক্ষ্য, ভাবনা ও উদ্দেশ্যে বদল আনার জন্যে একটা ম্যানিফেস্টো লিখেছিল 
    (অন দি কালচারাল ফ্রন্ট) 
    লোকটাকে  তার জন্যে কমিউনিস্ট পার্টি থেকে বহিষ্কার করা হয়েছিল
    লোকটা অকাতরে অজস্র সাক্ষাৎকার দিয়েছিল

    লোকটা শেষ জীবনে বেঘর হয়ে এখানে ওখানে এমনকি ফুটপাথেও কাটিয়েছিল 
    লোকটা টিউমার বার্স্ট করা সত্ত্বেও রোমান্টিক দৃশ্যে অভিনয় করেছিল 
    (তৃপ্তি মিত্রের সঙ্গে যুক্তি তক্কো আর গপ্পো)
    লোকটা শেষ জীবনে খেতে বসে কাশতে গিয়ে ভাতের থালায় রক্ত ছেটাত  
    লোকটা জীবন থেকে শিল্প আলাদা করতে পারেনি কোনোদিনও 

    লোকটাকে পি সি যোশী বলেছিল, ইউ আর দ্যা ওনলি পিপল আর্টিস্ট অফ ইন্ডিয়া
    মারি সিটন লোকটাকে ইনফ্যান্ট টেরিবল  নামে অভিহিত করেছিল 
    জর্জ সাঁদুল লোকটাকে বোনের ঘরে দাদার যাওয়ার দৃশ্যটি বাদ দিয়ে ভেনিস চলচ্চিত্রোসবে পাঠাতে বলেছিল 
    লোকটা রাজি হয়নি (সুবর্ণরেখা )
    লোকটাকে পদ্মশ্রী দেওয়া হয়েছিল তবে তা নিয়ে বিস্তর বিতর্কও হয়েছিল

    ঋত্বিক ১৯৪৭-৪৮ সালে

    লোকটার পুরো নাম ছিল  ঋত্বিককুমার ঘটক 
    লোকটা ঊনিশশো ছিয়াত্তর সালে পরপর তিনদিন অচৈতন্য অবস্থায় থেকে ফেব্রুয়ারির ছ-তারিখে রাত সাড়ে এগারোটায় পিজি হাসপাতালে মারা গেছিল 

    ঊনিশশো পঁচিশ সালের চৌঠা নভেম্বর তার জন্ম হয়েছিল 
    আজ তার জন্মদিন ছিল।
     

     

    সহায়তা - অভিজিৎ গোস্বামী।  

    বঙ্গদর্শনের সপ্তাহের বাছাই করা ফিচার আপনার ইনবক্সে পেতে

    @