No Image

   

00:00
00:00
Volume

 0 Songs

    খনা-মিহিরের ঢিপি

    খনা-মিহিরের ঢিপি

    Story image

    ‘Another site more promising for excavation that the fort is mound known as Varaha Mihir’s house just to the north east of the Berachampa railway Station.’ – লিখেছিলেন লঙ হার্স্ট। তখন মার্টিন রেল কম্পানির স্টেশন ছিল বেড়াচাঁপায়। চন্দ্রকেতুগড় অঞ্চলের ওই অংশটি পরিচিত ‘খনা-মিহিরের ঢিপি’ নামেই। বলা হয়, গুপ্তবংশের সম্রাট সমুদ্রগুপ্তের নবরত্নের অন্যতম, জ্যোতিষী বরাহের পুত্র মিহির ও পুত্রবধূ খনার বাসস্থান, গবেষণাগার ও মন্দির ছিল এখানেই। আশুতোষ মিউজিয়ামের নেতৃত্বে ১৯৫৬-৫৭ সালে এই অংশে খননের পর পাওয়া গেছে পোড়ামাটির পাত্র, পুঁথি, দামি পাথর, হাতির দাঁতের তৈরি নানাবিধ দ্রব্য, তামার মুদ্রা, পোড়ামাটির পুতুল, বিষ্ণুমূর্তি ইত্যাদি। খননকারীরা জানিয়েছেন, এটি আসলে একটি মন্দির ছিল। প্রায় দেড় হাজার বছর আগের এই মন্দিরের ভিত্তিভূমি ৩০০ ফুট দীর্ঘ, প্রস্থে ১০০ ফুট। চারপাশে ৬৩ ফুট বিস্তৃত এটি। ঢিপিটি খনন করে ৩৭টি ধাপবিশিষ্ট ইটনির্মিত সুদৃশ্য একটি গহ্বরও আবিষ্কৃত হয়েছে।

    প্রবাদ অনুযায়ী, বরাহ গণনা করে তাঁর পুত্রের আয়ু স্বল্প দেখে তাঁকে ভাসিয়ে দেন সাগরে। সেই পুত্র, মিহিরকে উদ্ধার করে লালন করেন সিংহলের রাজা। সিংহলরাজের কন্যাই ছিলেন খনা। মিহির ও খনা দু’জনেই একসঙ্গে বড় হয়ে ওঠেন এবং জ্যোতিষশাস্ত্রে পারদর্শী হন। বিবাহ হয় তাঁদের। পরবর্তীকালে মিহির খনাকে নিয়ে উজ্জয়িনীতে ফিরে আসেন এবং পিতা বরাহের সঙ্গে বসবাস করতে শুরু করেন। একদিন সমুদ্রগুপ্তের একটি প্রশ্নের উত্তর বরাহ ও মিহির দু’জনেই দিতে অসমর্থ হলেও খনা সঠিক সমাধান দেন এবং তা বরাহের ক্রোধের কারণ হয়। কেটে ফেলা হয় খনার জিভ।

    প্রবাদ অনুসরণ করে এতদূর তো পৌঁছনো গেল, কিন্তু এর সঙ্গে চন্দ্রকেতুগড়ের সম্পর্ক কী? খনাই বা বাংলায় প্রবচন দিতে পারদর্শী হয়ে উঠলেন কী করে? দেউলিয়ায় অবস্থিত ঢিপিটি ‘খনা-মিহিরের ঢিপি’ নামে পরিচিতই বা হল কেন? জ্যোতিষশাস্ত্রের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নানা জিনিস কিন্তু পাওয়া গেছে এখান থেকে – চুনী, পান্না, পোখরাজ, মৃৎফলক ও প্রস্তরফলকে রাশিচক্র ইত্যাদি। তাহলে কি সত্যিই লোককথা ভিত্তিহীন নয়? খনা-মিহিরের বাসস্থান ছিল এখানে? এই ঢিপিতে খননের ফলে প্রাপ্ত মন্দিরটির সঙ্গে গুপ্তযুগের সারনাথ ও নালন্দা মন্দিরের গঠনশৈলীর মিল কিন্তু নির্দেশ করছে ওঁদের সময়কালকেই।

    আবার অনেকে জানিয়েছেন, চন্দ্রকেতুগড় একসময় শুঙ্গ শাসকদের অধিকৃত ছিল। তাঁদের বৈদিক দেবতা পুষ্য মিত্র, অগ্নি মিত্র, ইন্দ্রাগ্নি মিত্র প্রভৃতি মিত্রকে স্মরণ করে নাম হয়েছিল সম্রাটদের। মিহির লোকমুখে ‘মিত্র’ শব্দেরই রূপান্তর। জনসাধারণই পরবর্তীকালে খনার নাম যুক্ত করেছিল তার সঙ্গে। সূর্যমূর্তি পাওয়া না গেলেও, মন্দিরের কুলুঙ্গিতে দেখতে পাওয়া গেছে পদ্মের নকশা। পদ্ম সূর্যের প্রতীক। আর মিহির শব্দের অর্থও ‘সূর্য’। ফলে, বৈদিক যুগের সূর্যদেবতার মন্দির ছিল এটি – এই সম্ভাবনাকেও উড়িয়ে দিতে নারাজ অনেকে। ঐতিহাসিক কমল চৌধুরী খনা-মিহিরের বসবাস ও মন্দির প্রসঙ্গে বলেছেন – ‘এটি সম্পূর্ণ অনৈতিহাসিক তথ্য। বহুকাল প্রচলিত হলেও, তাকে ইতিহাস হিসেবে খাড়া করা অযৌক্তিক।’

    শ্রীপারাবত তাঁর উপন্যাস ‘চন্দ্রকেতুগড়’-এ এটিকে খনা-মিহিরের বাসস্থান ও মন্দির হিসেবেই দেখিয়েছেন এবং খনা-মিহির চন্দ্রকেতুর সমসাময়িক – এ-বিষয়ও ধরা দিয়েছে তাঁর উপন্যাসে। তিনি লিখেছেন, চন্দ্রকেতুর রাজত্বকালে খনা-মিহির উজ্জয়িনী থেকে পলায়ন করে এখানে চলে আসেন। কিন্তু উপন্যাসের প্রয়োজনে ঘটনাটি এভাবে বর্ণিত হলেও, এটি সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। খনা-মিহির ছিলেন গুপ্তযুগের সমসাময়িক এবং ঢিপি থেকে প্রাপ্ত মন্দিরটিও সেই সময়েই নির্মিত। কিন্তু চন্দ্রকেতুর রাজত্বকাল ত্রয়োদশ শতাব্দীতে। ফলে উভয়ের মধ্যে কোনও যোগসূত্র থাকা অসম্ভব। তবে চন্দ্রকেতুর আমলেও মন্দিরটি স্বতন্ত্র অস্তিত্ব নিয়ে বর্তমান ছিল এবং প্রাপ্ত মূর্তি থেকে কেউ-কেউ অনুমান করেন ওটি একটি বিষ্ণুমন্দির ছিল। প্রসঙ্গত, ১৮৮৬ সালে কালীপ্রসন্ন চট্টোপাধ্যায় ‘ক্ষণা-মিহির’ নামে একটি উপন্যাস রচনা করেছিলেন। তাতে কিন্তু খনা ও মিহিরের দেউলিয়ায় আগমনের কোনও উল্লেখ নেই। লক্ষ্যণীয়, উপন্যাসটির ভূমিকায় কালীপ্রসন্ন’র বক্তব্য – ‘কেহ কেহ বলেন, মিহির কোন ব্যক্তির নাম নহে; উহা একটি উপাধি মাত্র। পণ্ডিত বরাহই মিহির-উপাধি প্রাপ্ত। বরাহ-পুত্রের প্রকৃত নাম প্রথুযশাঃ। কেহ বলেন, অথবা অনেকেই বলেন, মিহির স্বয়ংই এক ব্যক্তি বরাহের পুত্র।...’

    তবু, খনা-মিহিরের বঙ্গে আগমনের সপক্ষে কিছু বক্তব্য থেকেই যায়। দেউলিয়া ছাড়া অবিভক্ত বাংলার আর কোথাও খনা-মিহিরের বাসস্থান সম্পর্কিত কোনও জনশ্রুতি পাওয়া যায়নি। আর সবচেয়ে বড় সাক্ষী খনার প্রবচনগুলি। খনা যদি বাংলায় না-ই এসে থাকেন, তাহলে অন্য জনপদের নাগরিক হয়েও তৎকালীন গ্রাম্য বাংলাভাষায় এমন বচন তৈরি করার মত পারদর্শী হয়ে উঠলেন কী করে? বাংলার জলবায়ু, ভূ-প্রকৃতি ও চাষাবাদ সম্পর্কেই বা ওয়াকিবহাল হলেন কী করে? আমার ধারণা, একসময় খনার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিল সারা ভারতে এবং তাই স্থানীয় মানুষ কর্তৃক রচিত প্রবচনগুলিও মানুষের কাছে বিশ্বাসযোগ্য করে তোলার জন্য প্রচারিত হয় খনার রচনা হিসেবেই। এছাড়া অন্য কোনও সিদ্ধান্তে পৌঁছনো সত্যিই দুরূহ।

    বঙ্গদর্শনের সপ্তাহের বাছাই করা ফিচার আপনার ইনবক্সে পেতে

    @