No Image

   

00:00
00:00
Volume

 0 Songs

    মৃণালে জড়িয়ে থাকা মহাপৃথিবীর সন্ধানে

    মৃণালে জড়িয়ে থাকা মহাপৃথিবীর সন্ধানে

    Story image

    ‘ফাটলের মধ্য দিয়ে কবিতা অনুপ্রবেশ করে।’
    জঁ ককতো

    আমরা কোনোদিনও চমকে উঠিনি, মৃণাল সেন এতদিন আমাদের মধ্যে বেঁচে ছিলেন। আমরা খুব স্বাভাবিকভাবে এই সত্যিকে নিয়েছিলাম। বস্তুত এতই স্বাভাবিকভাবে, যে তথ্যটি ভুলেই গেছিলাম প্রায়। মৃণাল সেন প্রয়াত হওয়ার পর আমাদের আবার হুঁশ ফিরল, আমরা তাঁকে অক্ষর ও মুখের কথা দিয়ে স্মরণ করতে থাকলাম। এই ছবি গত পরশু থেকে কলকাতায় দেখা গেছে। কলকাতা মৃণাল সেনকে ভুলে যায়নি। 

    মৃণাল সেন একজন ব্যক্তিত্ব যাঁর কাছে অ্যালাঁ রেনে বা জঁ লুক গোদার বর্তমান থাকেন, চলচ্চিত্রের ইতিহাস যাঁর জানা, সোফিয়া লোরেন ও গার্সিয়া মার্কেস যাঁর বন্ধু ছিলেন, জাফর পানাহি কলকাতায় এসে যাঁর খোঁজ করেন--- এই তথ্যগুলিও আমরা জানি। 

    কলকাতা মৃণাল সেনকে ভুলে যায়নি। অন্তত মানেটা তেমনই দাঁড়াচ্ছে।

    মৃণাল সেন যৌবনের শুরুতে একটি রাজনৈতিক কাজ হিসেবেই চলচ্চিত্রকে দেখেছিলেন, জীবনের শেষ ছবি অবধি তাই দেখে গেছেন। এই রাজনীতি শুধু রাজনৈতিক বাস্তবের রেপ্লিকা হয়ে ছিল না, সিনেমাটিক ভাষাবদলও ছিল একটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। অনুজ ফরাসি নব্য তরঙ্গের উদ্দেশ্যও ছিল এমনটাই।

    ‘অপরাজিত’ মৃণাল সেনের কাছে সবচেয়ে সমকালীন ছবি ছিল। মৃণাল নিজে এই সমকালীনতার বিশ্বাসে চিরদিন স্থিত থাকতে চেয়েছেন। সমকালীনতা মানে, তিনি জানাচ্ছেন, সমসময়ের সাংবাদিক ধারাবিবরণী নয়, খ্রিস্টের জন্মের আগের ঘটনা অবলম্বনে লেখাও হয়ে উঠতে পারে চরম সমকালীন (যেমন তাঁর প্রিয় উপন্যাস স্পার্টাকুস), শুধু ইতিহাস সচেতন হতে জানতে হয়।
      

    মৃণাল সেন বিশ্ব চলচ্চিত্রের মানচিত্রে কাজ করেছেন একটি লম্বা সময় জুড়ে, অতএব তিনি সমকালীন হিসেবে যেমন পেয়েছিলেন কুরোসাওয়া-ডি সিকাকে, তেমনই কাহিয়ে দু সিনেমা গ্রুপকেও। চেকোস্লোভাকিয়া, পোল্যান্ড সহ ইউরোপিয়ন দেশগুলির নব্য তরঙ্গ ছিল মৃণালের সমকালীন, আশির দশকে আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার নতুন চলচ্চিত্র মৃণালের ছবি (আকালের সন্ধানে বা খন্ডহর)-এর পাশে হেঁটেছিল। 

    এমনকি, কালগত দিক দেখলে সহস্রাব্দ পার করে তিনি ছবি করেছেন (আমার ভুবন)-– তাহলে কার্লোস রেগাডস বা জাফর পানাহি-ও কি তাঁর সহকর্মী বলে বিবেচ্য হবেন?    

    আমরা এবার একটা অন্য ইতিহাস পড়ব। 

    মৃণাল সেন একটি বিশেষ সময়ের, বিশেষ প্রজন্মের অন্যতম শেষ প্রতিনিধি ছিলেন। এই সময়টি ছিল ভারতবর্ষের কমিউনিস্ট আন্দোলনের একটি চূড়ান্ত সময়। তেভাগা-তেলেঙ্গানা এদের স্মৃতিতে ছিল, উত্তর স্বাধীনতা পর্বে এরা কমিউনিস্ট বলেই নিষিদ্ধ হয়ে যান। সতীনাথ ভাদুড়ির ‘জাগরী’ উপন্যাসে, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘টিচার’ গল্পে এই ‘ওল্ড কমিউনিস্ট’দের কথা আমরা পড়েছি। 

    সমর সেন, অরুণ মিত্র, বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, আইপিটিএ গ্রুপ, বিজন ভট্টাচার্য, ঋত্বিক ঘটক-- প্রত্যেকে ছিলেন সাম্যবাদী ভাবাপন্ন ইন্টেলেকচুয়াল ও কেউ কেউ কমিউনিস্ট পার্টির মেম্বার। আমরা এই বিশেষ প্রজন্মটির কথা বলছি। মৃণাল সেন এদের একজন ছিলেন। 

    এর পরের সময়টা অতি দ্রুত বদলাতে থাকে এবং কমিউনিস্ট আন্দোলনের উৎকর্ষবিন্দুটি আমরা পাই ১৯৬৭-৭৪-এর  নকশালবাড়ি পর্বে, মৃণাল সেনের চলচ্চিত্রকে এই সময়টি সেঁকে নিয়েছে। ভুবন সোম যেমন ছিল আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র আন্দোলনের প্রতি একটি সমর্থনের বুড়ো আঙুল, কলকাতা একাত্তর একইভাবে গেরিলা চলচ্চিত্রের সম্ভাবনাকে খতিয়ে দেখবার একটি রাস্তা। (ইতালিয়ান গেরিলা ছবি সিয়েরা মায়েস্ত্রা মৃণালের প্রিয় কাজ ছিল।) পদাতিক বা কোরাসের মতো ছবি ছিল কমিউনিস্ট আন্দোলনের বিপন্নতা ও ব্যর্থতার উৎস খুঁজে দেখার প্রয়াস, একই সঙ্গে যেমন ছিল গণমানুষের সঙ্গে সংযোগস্থাপনের রাজনৈতিক ইচ্ছে (ব্রেশট আর চ্যাপলিন দুজনেই মৃণালের আচার্যপ্রতিম)।   

    এই উত্তাল সময় যখন স্মৃতি হয়ে যাচ্ছে, তখন মৃণাল সেন সমাজ বাস্তববাদের পথে হাঁটছেন (খারিজ), সেই বাস্তব থেকে বেরিয়ে আসছেন ডিসকোর্স রচনার কৌশলে (একদিন প্রতিদিন), বাস্তবকে অবাস্তবে বদলে দিচ্ছেন (চালচিত্র), সিনেমা ও বাস্তবের সম্পর্ক খতিয়ে দেখছেন এবং ঐতিহাসিক ট্রমা উসকে সমকালকেই আরেকবার যাচাই করছেন (আকালের সন্ধানে)। এই স্মৃতি যখন বিষণ্ণ ট্রমা হয়ে যাচ্ছে, বার্লিন দেওয়াল ও সোভিয়েত ভেঙে পড়ছে, তখন মৃণাল সেনের ছবির নাম হচ্ছে মহাপৃথিবী, যার থিমই হল ট্রমা (নকশাল আন্দোলন ও সোভিয়েত পতন-– দুই ঐতিহাসিক ঘটনাকে সমসময় থেকে দেখার চেষ্টা, বোঝার চেষ্টা।)

    আমাদের সমান্তরাল সাহিত্য, লিটিল ম্যাগাজিনের  সাহিত্যে এই ট্রমার যাচাই ও আন্তর্জাতিকতার সন্ধান ব্যাপকভাবে হয়েছে, আমরা অন্যতম দুজনের নাম করছি- নবারুণ ভট্টাচার্য ও সুবিমল মিশ্র। ‘হারবার্ট’ ও ‘যুদ্ধ পরিস্থিতি’ সোভিয়েত পতনের অব্যবহিত পরে লেখা; সুবিমলের লেখায় আন্তর্জাতিক সংযুক্তির প্রয়াস গোদারিয়ন ভাষার ব্যবহারে, কাট আপ পদ্ধতিতে, ডিস্কোর্স রচনার মাধ্যমে হাহাকারের মতো ব্যপ্ত হয়ে আছে।      

    আমরা দেখেছি, মৃণাল সেনের ছবি এই বাংলা সাহিত্যের সমান্তরাল ধারাটিকে কীভাবে খুঁজে যাচ্ছিল একটি বিরাট সময় জুড়ে, তরুণ লেখক আশীষ বর্মন ছিলেন মৃণালের কাহিনিকার (আকাশ কুসুম বা ইন্টারভিউ), কমিউনিস্ট অমলেন্দু চক্রবর্তীর অবিরত চেনামুখ মৃণালের হাতে রূপ পেয়েছিল একদিন প্রতিদিন–এ। সাহিত্য থেকে সিনেমা, সিনেমা থেকে সাহিত্য- এই লাগাতার যাতায়াত প্রক্রিয়াটির একজন অনিবার্য অংশ ছিলেন মৃণাল। 

    মৃণাল সেনের শেষ ছবি আমার ভুবন, যে ছবিতে লেগে ছিল একটি বিষণ্ণ ফোকলোরের সুর। যে ছবি ছিল একেবারেই রাজনৈতিক বাস্তবতার কেন্দ্রে। ২০০২ সালের পর মৃণাল আর ছবি করেননি। সালটা খুব গুরুত্বপূর্ণ-- এর একবছর দুবছরের এদিক ওদিকে ৯/১১, গোধরা, ইরাক যুদ্ধ, ডিজিটাল বিপ্লব, বামপন্থার প্রায় বিলয়ের মতো ঘটনাগুলি ঘটে যাবে। 

    কলকাতা যোগাযোগ স্থাপনের ভাষা ভুলে গেছে কারণ সে মৃণাল সেনকে স্মরণ করতে গিয়ে কিছু নীরস, রংচটা, তথ্যে ঠাসা, ক্লিশেতম মুখের কথা ও অক্ষরের আশ্রয় নিচ্ছে। কলকাতা মৃণাল সেনের কাছে এমন কোনো সিনেমাটিক সম্পদের নজির গত তিরিশ বছরে রাখতে পারেনি যা থেকে প্রমাণ হবে, তার কাছে মৃণাল সেন ইতিহাসগতভাবে অস্তিত্ববান ছিলেন। 

    তবু, এখনও আমার চেনা কয়েকজন ইতিহাস-সচেতন লেখা লেখে, রাজনৈতিক ছবি বানাতে চায়, তাদের প্রতি আমার বুড়ো আঙুল তোলা রইল । 

    তাদের বলব, মৃণাল সেন চলে গেছেন, অর্থাৎ আমাদের দায়িত্ব বেড়ে গেছে। সেই মুহূর্ত থেকেই।

    আর যদি পৃথিবীই না থাকে? যদি আমাদের মনে না রাখে পৃথিবী? 
    আমরা পৃথিবীকে সিনেমার জন্য মনে রাখব।

    বঙ্গদর্শনের সপ্তাহের বাছাই করা ফিচার আপনার ইনবক্সে পেতে

    @