No Image

   

00:00
00:00
Volume

 0 Songs

    রবীন্দ্রসংগীতের প্যারডিই হয়ে উঠল নতুন নজরুলগীতি

    রবীন্দ্রসংগীতের প্যারডিই হয়ে উঠল নতুন নজরুলগীতি

    Story image

    ট্রেনে যেতে যেতে রবীন্দ্রসংগীতের প্যারডি করলেন নজরুল ইসলাম। আর সেই প্যারডিই পরে হয়ে উঠল সম্পূর্ণ নতুন এক গান। বিখ্যাত রবীন্দ্রসংগীত থেকেই জন্ম নিল নজরুলগীতি। এমন নানা বিস্ময়ের জন্ম অনায়াসেই দিতে পারতেন নজরুল। এই ঘটনাও তেমনই। নজরুলকে নিয়ে স্মৃতিচারণায় যার হদিশ দিয়েছেন নিতাই ঘটক।

    উমাপদ ভট্টাচার্যর মেয়ের বিয়ে। নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে রাত্রি সাড়ে দশটার লালগোলা প্যাসেঞ্জারের একই ইন্টারক্লাসে চেপে বহরমপুরের উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন নজরুল ইসলাম, নলিনীকান্ত সরকার, অনিল বাগচি, নিতাই ঘটকরা। ট্রেনের কামরা ফাঁকা। একটা জানলার পাশের সিটে বসলেন নজরুল। শেষরাত্রে বহরমপুর২ স্টেশন আসবে। ফলে, ট্রেনে উঠেই ঘুমোনোর তোড়জোড় শুরু করলেন সবাই। নজরুল ব্যতিক্রম। দোল পূর্ণিমার আগের রাত। জানলার বাইরে তখন দিগন্তপ্লাবী জ্যোৎস্না। চন্দ্রাহত নজরুল নলিনীকান্ত সরকারকে বললেন—‘নলিনীদা বাইরেটা একবার দ্যাখো, এ দৃশ্য দেখে কি চোখে ঘুম নামতে চায়?’

    অতএব, জ্যোৎস্নার নেশা সংক্রামিত হল বাকিদের মধ্যেও। ঘুমের দফারফা হল। নলিনীকান্ত প্রস্তাব দিলেন— ‘এস আমরা বসে বসে এ দৃশ্য দেখি আর কিছু একটা করি। ধর, দড়ি গানের প্যারডি করি--- একে প্যারডির লড়াইও বলতে পার।’ জমে উঠল প্যারডির লড়াই। তার ভাষায় ধীরে ধীরে জড়িয়ে গেল আদিরস। এদিকে নজরুল ইসলাম তখনো যোগ দেননি গানের খেলায়। তিনি তখনো জ্যোৎস্নায় বুঁদ।

    কিন্তু, নজরুলকে তো ছাড় দেওয়া যায় না। আবদারের পর প্যারডি রচনায় রাজি হলেন নজরুল। কিন্তু, রেডিমেড প্যারডি তো নেই। তাঁকে দেওয়া হল রবীন্দ্রনাথের গান-- ‘আমায় ক্ষমো হে ক্ষমো নমো হে নমো’। নলিনীকান্ত ও বাকিরা একি-দু লাইন করে গানটি গান আর নজরুল মুখে মুখে তার প্যারডি রচনা করে চলেন। মূল রবীন্দ্রসংগীতে ছিল—

    ‘আমায় ক্ষমো হে ক্ষমো নমো হে নমো
    তোমায় স্মরি হে নিরুপম
    নৃত্য রসে চিত্ত মম, উচ্ছল হ’য়ে বাজে’
    নজরুলের প্যারডিতে তা হয়ে দাঁড়াল—
    ‘ওহে, শ্যামো হে শ্যামো নামো হে নামো
    কদম্বডাল ছাইড়া নামো
    দুপুর রোদে বৃথাই ঘামো--- ব্যস্ত রাধা কাজে’

    এই গানের এমন প্যারডি নির্মাণ হয়তো নজরুলের পক্ষেই সম্ভব। ততক্ষণে গানের ঘোর পেয়ে বসেছে তাঁকে। প্যারডি এগোতেই থাকে--

    ‘আহা ললিতা দেবী সলিতা পাকায়,
    বিশাখা ঝুলে হিজল শাখায়,
    বিন্দাদূতি পিন্দা ধুতি...

    এইখানটায় এসে খানিক আটকে যান কবি। তালে তাল দিয়ে, মাথা ঝাঁকিয়ে গুনগুন করতে থাকেন পরের সম্ভাব্য লাইনগুলো। ইতিমধ্যে নিতাই ঘটক কখন পকেট থেকে বের করে নিয়েছেন কলম। শোওয়ার জন্য পেতে রাখা খবরের কাগজেই সবার অলক্ষে লিখে রেখেছেন এক কিংবদন্তির লেখা গান নিয়ে আরেক কিংবদন্তির এই ঐতিহাসিক প্যারডি। একে কি হারিয়ে যেতে দেওয়া যায় নাকি!

    যাইহোক, ‘বিন্দাদূতি পিন্দা ধুতি’ লাইনটাকে ততক্ষণে বদলে দিয়েছেন নজরুল। তার বদলে জুড়েছে নতুন লাইন— ‘পিন্দা ধুতি গোষ্ঠে গেছেন সাইজা রাখাল সাজে। বাকি রচনাটিও গড়গড়িয়ে এগোতে থাকে রাতের লালগোলা প্যাসেঞ্জারের মতো---

    তুমি ইতিউতি চাও বৃথাই,--- কমু না—
    কোথায় তোমার যমুনা,
    কলিকাতা আর ঢাকা, রমনার
    লোকে পাইব্যা তার নমুনা।
    কলেজে ফিরিছে ছিদাম-সুদাম,
    মাইর্যাি মালকোঁচা খুইল্যা বোতাম।
    লাঙ্গল ছাইড়্যা বলরাম ডাম্বেল-মুদ্‌গর ভাঁজে।।’

    রবীন্দ্রনাথের গানের আকুল সমর্পণকে নজরুল স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে বদলে দিলেন মজায়। সেই মজার ভিতরে আবার জড়িয়ে গেল রাধা, কৃষ্ণ, বলরাম, কৃষ্ণসখীর অনুষঙ্গ। ব্রজলীলার আধুনিকীকরণও হল। মূল রচনার গম্ভীর ভাবকে লঘু, হাস্যরসে বা ব্যঙ্গে বদলে নেওয়াই তো প্যারডির কাজ। নজরুল সেটাই ঘটালেন এত অনায়াসে। মূল রবীন্দ্রসংগীতের সুর, তাল সামান্য লঙ্ঘিতও হল না, মিশল না আদিরসের ভেজাল, অথচ প্যারডির মেজাজে তিলমাত্র টালও পড়ল না। জিনিয়াস বলেই হয়তো সম্ভব।

    হোক না প্যারডি, একই রচনার অনুষঙ্গে এই সুযোগে সমাপতিত হলেন রবীন্দ্রনাথ আর নজরুল—সেই বা কম পাওয়া নাকি!

    গল্পের এখানেই শেষ নয়। এই প্যারডিকে হেলায় হারিয়ে যেতে দিয়েছিলেন সৃষ্টিকর্তা। কিন্তু, গানটি তো লুকিয়ে টুকে নিয়েছিলেন নিতাই ঘটক। পরে, এই গানটিই কাজে লেগে গেল। একবার পুজোর রেকর্ডের সময় রঞ্জিত রায়ের জন্য একখানা গান খুব দ্রুত লিখে দেওয়ার প্রয়োজন পড়ল। এহেন ফরমায়েশের মুখে খানিক সমস্যায় পড়লেন নজরুল। তখন নিতাই ঘটক লালগোলা প্যাসেঞ্জারে টুকে নেওয়া সেই প্যারডি দেখান তাঁকে। দেখে যেন হাতে চাঁদ পান নজরুল। সেই প্যারডিকেই সামান্য বদলে বানিয়ে তোলেন নতুন গান। আর সেটাই রেকর্ডে গান রঞ্জিত রায়। 

    রবীন্দ্রসংগীতের প্যারডি থেকে নজরুলের গান। ফরমায়েশি, পেশার প্রয়োজনে, তবু নজরুলেরই গান। রবীন্দ্রসংগীত তো বটেই আর কোনো বাংলা গানের এমন ভোলবদল আর কখনো কেউ দেখেছে কিনা সন্দেহ। 

    খেয়ালে আর প্রতিভায় এমন নানা বিস্ময়ের জন্মই দিতে পারেন জিনিয়াসরা। অন্যক্ষেত্রে, রবীন্দ্রনাথের এমন গান নিয়ে চটুল ও লঘু প্যারডি হয়তো ভালো চোখে দেখতেন না বঙ্গবাসী। কিন্তু, এক্ষেত্রে তো প্যারডি-রচয়িতার নাম নজরুল ইসলাম। আর, সেই প্যারডিই যখন একদম নতুন গান হয়ে ওঠে—তখন তার আড়াল থেকে রবীন্দ্রনাথকে খুঁজে পান, এমন সাধ্য কার!

    দুই কিংবদন্তী, একটি গান, তার প্যারডি এবং তা থেকেই নতুন আরেকটি গান। ঐতিহাসিকই বটে। 

    সূত্র: নজরুলগীতির স্মৃতি, নিতাই ঘটক, বাংলা গান অদীন ভুবন, সম্পা: সুধীর চক্রবর্তী
     

    বঙ্গদর্শনের সপ্তাহের বাছাই করা ফিচার আপনার ইনবক্সে পেতে

    @