পৌষমেলার আগে নন্দন মেলায় মেতে উঠছেন শিল্প-রসিকেরা

শান্তিনিকেতনের পৌষমেলার কথা তো সবাই জানেন, কিন্তু ডিসেম্বরের শুরুতেই বিশ্বভারতীর কলাভবনের ‘নন্দন মেলা’র কথা সবাই জানেন কি? ডিসেম্বরের ১ আর ২। কলাভবন প্রাঙ্গন সেজে ওঠে আশ্চর্য সব ইন্সটলেশনে। শুধুমাত্র দুইদিনের এই মেলার টানেই আপনি বারবার ফিরে যেতে পারেন লাল মাটির দেশ শান্তিনিকেতনে। মূল আকর্ষণ ভিন্ন রকমের শিল্পচিন্তা। আর পাঁচটা সাধারণ মেলার থেকে নন্দন মেলা একেবারেই আলাদা। এই মেলার অভিজ্ঞতা আপনাকে ভাবনার রসদ জোগাবে, মেলা ঘোরা হয়ে উঠবে সুখময়।
প্রখ্যাত ভারতীয় চিত্রশিল্পী নন্দলাল বসু বিশ্বভারতীর কলাভবনে অধ্যক্ষ পদে নিয়োজিত হন ১৯২২ সালে। তাঁকে স্মরণ করে তাঁর নামানুসারেই এই মেলা। নন্দলাল থেকে নন্দন। ১৮৮২ সালের ৩ ডিসেম্বর নন্দলাল বসুর জন্মদিন। আচার্যের জন্মদিনটি কলা ভবনের ছাত্রছাত্রী, অধ্যাপকেরা বৈতালিক গেয়ে পালন করতেন। ১৯৭২ সালে কলাভবনের প্রথম বর্ষের ছাত্র বীরেন বোরা এক দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত হন। তখন তাঁর চিকিৎসার জন্য প্রচুর টাকার দরকার ছিল। ছাত্রছাত্রী- অধ্যাপকেরা মিলে ঠিক করলেন, ছাত্র তহবিলের জন্য একটি স্থায়ী তহবিল গড়ে তুলতে হবে। তার ঠিক পরের বছর থেকেই শুরু হল নন্দন মেলা। লক্ষ্য একটাই- ওই ছাত্র কল্যাণ তহবিল। এই মেলায় নানা শিল্প সামগ্রী বিক্রি করা হয়। সেখান থেকে উপার্জিত অর্থ জমা পড়ে তহবিলে। এই ভাবনাটি যাদের মাথায় প্রথম আসে, তাঁরা হলেন, প্রয়াত শিল্পী দিনকর কৌশিক এবং অজিত চক্রবর্তী।
আচার্য নন্দলাল বসুর জন্মদিন যেহেতু ৩ ডিসেম্বর, তাই তাঁকে স্মরণ করেই প্রতিবছর ডিসেম্বরের ১ আর ২ ছাত্রছাত্রীদের আদরে সেজে ওঠে কলাভবন প্রাঙ্গন। এই মেলায় মূলত কলাভবনের ছাত্রছাত্রীদের পেন্টিং, স্কাল্পচার, গ্রাফিক্স ডিজাইন, মাটির গয়না, ডোকরা, সেরামিক্স, মাটির বাসন, বিভিন্ন ইন্সটলেশন ইত্যাদি স্থান পায়।
কলাভবনের এই নন্দন মেলা বর্তমানে শিল্প ও সংস্কৃতির একটি গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক মঞ্চ হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছে। মেলায় দেশি-বিদেশী শিল্পী ছাত্রছাত্রীরা তাঁদের শিল্পকর্মের পসরা সাজিয়ে বসেন। পাশাপাশি পরিবেশন হয় নানা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানও। দুদিনের এই শিল্প-সংস্কৃতির মেলায় দেশ-বিদেশ থেকে বহু পর্যটকের সমাগম হয়। শিল্পকর্ম বিক্রি থেকে উপার্জিত অর্থ ছাত্রছাত্রী কল্যাণ তহবিলে জমা পড়ে। দুর্ঘটনাগ্রস্ত ছাত্রছাত্রীদের সাহায্য করার পাশাপাশি সেই তহবিল থেকে দুস্থ পড়ুয়াদের বৃত্তিও দেওয়া হয়ে থাকে।
দুই দিন বিকেল থেকেই নানা রকমের রঙিন আলোর রোশনাইয়ে ভেসে যায় গোটা কলাভবন চত্বর। সিনিয়রদের স্টলে আসেন জুনিয়ররা। ছাত্রছাত্রীরা নন্দন মেলাকে তাঁদের পুনর্মিলন উৎসব বলে মনে করেন। অতীতের বিশিষ্ট শিক্ষক-শিল্পীদের স্মৃতিচারণা করেন কেউ কেউ, আবার কেউ মেতে ওঠেন সাম্প্রতিক শিল্পচর্চায়। বিভিন্ন প্রদেশের ছাত্রছাত্রীরা সমবেত হয়ে চাতালে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন। কলাভবনের ছয়টি বিভাগের জন্য ব্যবস্থা করা হয় আলাদা আলাদা ছয়টি স্টল। শিল্পকর্ম বিকিকিনির পাশাপাশি বিদেশী ছাত্রছাত্রীদের উদ্যোগে মেলায় নানারকম খাবারের স্টল বসানো হয়। এইবছর নন্দন মেলা ৪৫ তম বর্ষে পা দিল।