কলকাতা জুড়ে স্থাননাম ঘিরে হরেক প্রশ্ন

উত্তর শহরতলির ডানলপ মোড়ে বছর কয়েক আগে একটি সুদৃশ্য ফ্লাইওভার নির্মিত হয়েছে, আর ঠিক তার নিচের তিনমাথা মোড়ে একইসঙ্গে স্থাপিত হয়েছে শহিদ ভগৎ সিং-এর পূর্ণাবয়ব একটি মর্মরমূর্তি। অমন ব্যস্ত রাজপথের রেলিং-ঘেরা চৌহদ্দিতে দেশের এক উজ্জ্বল সন্তান দক্ষিণ দিকে মুখ করে তাকিয়ে কী ভাবছেন? ব্যস্ত মোড়ের ট্র্যাফিক-সিগন্যালে আটকে-থাকা বাসের কোনও উৎসুক আরোহী ভাবতেই পারেন, শহিদ ভগৎ সিং-এর মূর্তি এখানে স্থাপন করার প্রেক্ষিতটা ঠিক কী? ভগৎ সিং সুদূর পঞ্জাব প্রদেশের মানুষ, তিনি কি কখনও এই এলাকায় এসেছিলেন বা বসবাস করেছিলেন? স্বাভাবিকভাবেই এইসব প্রশ্নের উত্তর হল ‘না’। ইতিহাস ঘেঁটে যতদূর জানা যায়, বরানগর এলাকার যোগেন্দ্র বসাক লেনের (বর্তমান বরানগর থানার বিপরীত দিকের রাস্তা) একটি বাড়িতে ১৯২৮ এর ডিসেম্বর মাসে একবার মাত্র কিছুক্ষণের জন্য এসেছিলেন ভগৎ সিং। উদ্দেশ্য ছিল অনুশীলন সমিতির আদি-পর্বের বিপ্লবী-সংগঠক যতীন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে দেখা করা। যিনি ততদিনে রাজনীতির সংশ্রব ছেড়ে ‘নিরালম্ব স্বামী’ নাম নিয়ে সাধু হয়ে গেছেন। ওইসময় তিনি ওই বাড়িতে তাঁর এক শিষ্যের কাছে ছিলেন। এই তথ্য খুব কম মানুষই জানেন। তাছাড়া ওই এলাকা থেকে ডানলপ মোড়ের দূরত্ব কম-বেশি দু-কিলোমিটার।
আসলে এর পেছনে একটা অন্য গল্প। বেশ কয়েক বছর আগে ডানলপ এলাকার সম্পন্ন শিখ-ব্যবসায়ীদের এক সংগঠন ভগৎ সিং-এর মূর্তি প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন। তৎকালীন পূর্তমন্ত্রী ডানলপ মোড়ের পাশেই একটুকরো জায়গায় সেই উদ্যোগের ভিত্তিপ্রস্তর উদ্বোধন করেন। পরে রাস্তা চওড়া করার জন্য ওই টুকরো-জমি সম্প্রসারিত রাস্তার মধ্যে চলে গেলে বিকল্প হিসেবে উড়ালপুলের নিচে অমর বিপ্লবীর পুনর্বাসন ঘটে। কিন্তু কথাটা এইসব নিয়ে আসলে নয়। ভারতের যেসব ধর্মীয়-সম্প্রদায় নিজেদের পোশাকে-আশাকে ধর্মীয় পরিচয়কে প্রধান করে রাখেন শিখ-সম্প্রদায় তাঁদের অগ্রগণ্য। অথচ ভগৎ সিং আমৃত্যু নিজেকে ঘোষিত ভাবে নাস্তিক ও বিশেষ কোনও ধর্ম-পরিচয়ে আস্থাহীন বলে দাবি করে এসেছেন। ফাঁসির আগে জেল থেকে লেখা তাঁর ডায়েরির ছত্রে ছত্রে সেই দৃপ্ত ঘোষণার ইঙ্গিত। তাই এমন এক মুক্তমনা বিপ্লবীকে কোনও বিশেষ ধর্মীয়-সম্প্রদায় নিজেদের ‘আপনজন’ হিসেবে চিহ্নিত করতে চাইলে আসলে তাঁর বিশ্বাসেরই একরকম ঐতিহাসিক অবমাননা ঘটে। মনে হয় না, ধর্মীয় পরিচয়ের ভিত্তিতে তাঁর প্রতি এই শ্রদ্ধা-প্রদর্শনের ভঙ্গিটা খুব সংগত, বরং স্পষ্টতই বেশ বেমানান।
সমস্যা হল সারা কলকাতা জুড়েই এই বেমানান ও বেখাপ্পা শ্রদ্ধা-প্রদর্শনের এক বহুকালীন ট্র্যাডিশন সমানে চলেছে। আজও যার ধারাবাহিকতা সজীব ও সতেজ। ধরা যাক, লর্ড আমহার্স্ট এর নামে নামাঙ্কিত যে রাস্তা এখন চিহ্নিত হয়েছে রাজা রামমোহনের নামে তার আনুমানিক ভিত্তি হল ওই রাস্তায় অবস্থিত রাজা রামমোহনের একটি বসতবাটি, যা এখন ‘রামমোহন স্মারক মিউজিয়াম’ হিসেবে বিজ্ঞাপিত। কিন্তু কলকাতা-গবেষকরা খুব নির্দিষ্টভাবে প্রমাণ করেছেন ওই বাড়ি রামমোহনের নির্মিত নয় বা ওখানে রামমোহন কখনও বসবাস করেননি! আবার এই বসতবাটিকে ভিত্তি করেই রবীন্দ্রনাথ, বিবেকানন্দ ও বিদ্যাসাগরের নামে রাস্তার নামকরণ হলেও নেতাজি সুভাষচন্দ্রের নামাঙ্কিত রাস্তাটির ধারেকাছেও তার পৈতৃক বসতবাটি নয়। সম্পূর্ণ অফিস পাড়া ও বাণিজ্যিক এলাকার একটা রাস্তা সুভাষচন্দ্রের নামে চিহ্নিত করার ভিত্তি কী? এই প্রশ্নের জবাব কেউই জানেন না।
একইভাবে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জনের নামে কলকাতার যে রাস্তা তার সঙ্গে চিত্তরঞ্জনের পারিবারিক বসতবাটির কোনও ন্যূনতম সংযোগবিন্দু খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। এমনকি যে-হাইকোর্টের ব্যারিস্টার হিসেবে তার দেশজোড়া খ্যাতি ছিল, সেই হাইকোর্টের আশেপাশের কোনও রাস্তাতেও তাঁর নামের স্পর্শ নেই। বরং সেখানে যে কিরণশংকর রায়ের নামে রাস্তা, তাঁর একমাত্র পরিচয় তিনি কংগ্রেস দলের একসময়ের নামি নেতা, স্বাধীন পশ্চিমবাংলার প্রথম স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। কর্মস্থলের সূত্রেই মানুষ অনেকটা বেশি চেনেন বিদ্যাসাগরকেও, কিন্তু সংস্কৃত কলেজের সামনের রাস্তার নাম তাঁর নামে হয়নি, হয়েছে বঙ্কিমচন্দ্রের নামে (তাও আবার বঙ্কিম চ্যাটার্জী স্ট্রিট, চট্টোপাধ্যায় নয়)। বঙ্কিমচন্দ্র একসময় বাস করতেন কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের বিপরীত দিকে প্রতাপ চ্যাটার্জী স্ট্রিটে, তাহলে ওই এলাকার রাস্তাটিই তো তাঁর নামে করবার যোগ্য বিকল্প হতে পারত। কেন হয়নি? ওদিকে বিদ্যাসাগরের বসতবাটির লাগোয়া যে-রাস্তা তাঁর নামে, সেই বসতবাটি দীর্ঘ অবহেলায় বেদখল ও জীর্ণ। একইভাবে হয়তো আপার সারকুলার রোডের এ পি সি রোড হওয়ার থেকে বাঞ্ছিত ছিল মানিকতলায় বেঙ্গল কেমিক্যালের কারখানা-সংলগ্ন রাস্তার নাম আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্রের নামে হওয়া। যেমন একই ভাবে জানা মুশকিল, ক্যামাক স্ট্রিটের নাম অবনীন্দ্রনাথের নামে রাখার প্রকৃত যুক্তি কী?
আরও পড়ুন
বাংলায় সঠিক বানান লেখার দায় কাদের?
সম্প্রতি আলিপুরের জিরাট ব্রিজের নাম বদলে রাখা হয়েছে সারদামণি সেতু – ওই প্রাচীন এলাকার সঙ্গে কোনওসময় সারদামণির কোনও যোগাযোগ ছিল বলে জানা যায় না। বরং রামকৃষ্ণদেবের জীবনকালের শেষ পর্বে কাশীপুর উদ্যানবাটিতে সারদামণি তাঁর সঙ্গে থাকতেন, এর সপক্ষে জোরালো ঐতিহাসিক প্রমাণ আছে। ওই জায়গাটা নির্বাচন করা হল না কেন?
শিয়ালদহ রেলস্টেশন থেকে হাওড়া ব্রিজ পর্যন্ত জনাকীর্ণ বসতি এলাকায় অনেক পরিকল্পনা করে পঁচাত্তর ফুট চওড়া রাস্তা তৈরি করা হয় ১৮৯২ সালে, যার মূল কৃতিত্ব তৎকালীন কলকাতা পুরসভার চেয়ারম্যান হেনরি হ্যারিসনের। কিন্তু সেই হ্যারিসন রোডের ঐতিহাসিক প্রেক্ষিত ভুলে গিয়ে ওই রাস্তার সঙ্গে জাতির জনকের নাম জুড়ে দেওয়া বলতে গেলে প্রায় ঐতিহাসিক ভুল। রবীন্দ্রনাথের কবিতাতেও হ্যারিসন রোডের নাম উল্লেখ আমাদের মনে না-পড়ে উপায় নেই। বরং ১৯৪৭ এর স্বাধীনতার দিন এই শহরেই গান্ধিজি অনশনে বসেছিলেন অন্য এক এলাকায়, ওইটাই তো ছিল তাঁর নামের সঙ্গে জুড়ে শ্রদ্ধা জানানোর ইতিহাস-অনুগত দায়। ঠিক একই ধরনের ইতিহাস বিরোধী হাস্যকর কাজ অক্টারলোনি মনুমেন্টের নাম পালটে শহিদ মিনার রাখা। ১৮২৮ সালে ডেভিড অক্টারলোনির স্মরণে যখন এই সৌধ নির্মাণ হয়, তখন সেই অর্থে ভারতে ‘জাতীয়তাবাদ’ শব্দটার অস্তিত্বই ছিল না – শহিদরা তখন কোথায়? একইভাবে পার্ক স্ট্রিট-এর নামের সঙ্গে কলকাতার যে-ইতিহাস অঙ্গাঙ্গী হয়ে আছে তার নাম পালটে মাদার টেরিজার নামে রাখা সমর্থন করা যায় না।
আসলে একটু তলিয়ে দেখলেই দেখা যাবে, এই রাস্তার নামকরণ বা নামবদলের সঙ্গে একরকমের রাজনৈতিক আধিপত্যের নিবিড় যোগ রয়েছে। স্বাধীনতা-উত্তর পশ্চিমবাংলার প্রথম-পর্বে কংগ্রেস দলের দীর্ঘকালীন শাসন তাঁদের অবাধ অধিকার দিয়েছে রাস্তাঘাটের নাম যেমন-তেমন ভাবে পালটে দেওয়ার। সেখানে তাঁদের রাজনৈতিক অভিমুখের পক্ষপাত ধরা পড়ে যখন ভারতের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের ইতিহাসে সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্ত বা ভূপেন্দ্র বসুর নাম প্রায় একই ব্র্যাকেটে রেখে তিনজনের নামেই রাস্তার নাম রাখা হয়। এঁদের কারোর রাজনৈতিক সত্ত্বার প্রতি অশ্রদ্ধা না দেখিয়েও এই প্রশ্ন তোলা যায়। অগ্নিযুগের বিপ্লবী-আন্দোলনকে জাতীয় কংগ্রেস কোনোদিনই খুব একটা ভালো চোখে দেখেনি। ফলে অরবিন্দ ঘোষ (যদিও বিপ্লবী আন্দোলনের পথিকৃৎ অরবিন্দ-র থেকে ‘ঋষি’ অরবিন্দকেই বেশি প্রচার দেওয়া হয় ) বা সূর্য সেনের নামে উল্লেখযোগ্য রাস্তার নাম রাখা হলেও সমকালীন বিপ্লবী উল্লাসকর দত্ত (যিনি স্বাধীন ভারতে সরকারি খেতাব ও পেনশন নিতে অস্বীকার করেন) বা বারীন ঘোষের নামে চিহ্নিত রাস্তাগুলি খুবই কম গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় অবস্থিত। যতদূর জানা যায়, দীর্ঘ আত্মগোপন-পর্বে সূর্য সেন একসময় দক্ষিণেশ্বর এলাকার একটি বাড়িতে কিছুকাল বাস করেছিলেন, যদিও বর্তমান সূর্য সেন স্ট্রিটের সঙ্গে তার দূরত্ব কয়েক কিলোমিটার।
ভাবলে একটু অবাকই লাগে, নামকরণ আর নামবদলের এই ধারাবাহিক হুজুগে আমরা খেয়াল করে দেখি না আজও কলকাতা শহরে সুকুমার রায় বা উপেন্দ্রকিশোরের নামে কোনও উল্লেখ্য রাস্তা নেই! নেই ‘ইয়ং বেঙ্গল’-এর স্রষ্টা ‘ঝড়ের পাখি’ ডিরোজিওর নামে, নেই বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসুর নামেও !
ভুল হয়ে গেছে বিলকুল?
আরও পড়ুন
সাকিন চেনা যায় বাসের নম্বরে
তথ্যঋণ :
কলিকাতা দর্পণ (১ম ও ২য় খন্ড)—রাধারমণ মিত্র
দীপ্ত শিখার অগ্নি – সন্দীপ বন্দ্যোপাধ্যায় (সম্পাদিত)
(মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)