প্রভাত পট্টনায়েকের মার্ক্স বি-চিন্তা

সিপিআই(এম)-এর অর্থশাস্ত্র-বিষয়ক তাত্ত্বিক অধ্যাপক প্রভাত পট্টনায়েক (একজন উঁচুমানের ও ছাত্র-দরদী শিক্ষক হিসেবে যাঁর সুখ্যাতি অনেক শিক্ষকের কাছে ঈর্ষণীয়) এক বিশিষ্ট অর্থশাস্ত্রবিদ এবং সিপিআই(এম)-এর অর্থশাস্ত্রবিষয়ক তাত্ত্বিক ও জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের এমারিটাস প্রোফেসর। ‘মার্ক্সবাদী’ মহলে তিনি উচ্চ-প্রশংসিত। প্রভাতী দৈনিক টেলিগ্রাফ-এ তিনি লিখেছেন যে, কার্ল মার্ক্স ‘দাস কাপিতাল’-এ উপনিবেশবাদী শোষণের সঙ্গে উদ্বৃত্ত মূল্য আত্মসাৎকরণের সম্পর্ক বিষয়ে নীরব। সিপিআই(এম)-এর প্রধান মুখপত্র ‘পিপলস ডেমক্র্যাসি’তেও একই বক্তব্য পেশ করেছি। তাই ধরে নিতে হচ্ছে, এটা পিপলস ডেমক্র্যাসি’র সম্পাদক প্রকাশ কারাট ও পার্টি নেতৃত্বেরও অনুমোদিত অভিমত। বিনীতভাবে জানাতে চাই, এই বক্তব্য অসত্য।
ডঃ পট্টনায়েক ‘টেলিগ্রাফ’ দৈনিকে ২০ ডিসেম্বর ২০১৭-য় লিখেছেন যে, মার্ক্স তাঁর সবচেয়ে বড় কাজ, ‘পুঁজি : রাজনৈতিক অর্থনীতির সমালোচনা’( সংক্ষেপে ‘পুঁজি’) গ্রন্থে উপনিবেশবাদ সম্পর্কে নীরব। প্রবন্ধের শিরোনাম, “মার্ক্স অ্যান্ড নাওরোজিঃ দি ক্লু টু দি পাজল অফ দি ‘ড্রেন অফ ওয়েলথ’”। এতে মার্ক্স-বিরোধীরা(বিশেষত যাদের লেখাপত্রে মার্ক্সের বিরুদ্ধে ‘প্যাথলজিকাল আনাথেমা’ অর্থাৎ উৎকট উষ্মা কারণে-অকারণে প্রকাশ পায় ও মার্ক্সের বক্তব্যের উদ্দেশ্যপ্রণোদিত অপব্যাখ্যা থাকে) পট্টনায়েক-স্তুতিতে মুখর হয়েছেন।
মার্ক্সের লেখায় অসম্পূর্ণতা ছিল, থাকাটা অস্বাভাবিক নয়। কারণ মার্ক্সের মানসিকতায় ছিল সায়েন্টিফিক টেম্পার। তাই তিনি শুধু কমিউনিস্ট ইস্তাহার নয়, পুঁজিও বারবার পুনর্লিখন করতে চেয়েছিলেন। এমনকি অষ্টাদশ ব্রুমেয়ার ও গোথা কর্মসূচির সমালোচনাও নতুন করে লিখতে চেয়েছিলেন। এই অসম্পূর্ণতার মধ্যেই রয়েছে মার্ক্সীয় চিন্তন-চর্চার সৃষ্টিশীলতার প্রেরণাম মার্ক্সীয় মেজাজ। বছর তিনেক আগে আমস্টার্ডাম-এ আন্তর্জাতিক মার্ক্স-এঙ্গেলস চর্চা নিধি-তে(ইমেস –যেখান থেকে মার্ক্স ও এঙ্গেলস এর সমস্ত প্রকাশিত মূল রচনাবলি, চিঠিপত্র এবং অপ্রকাশিত পাণ্ডুলিপি, লেখাজোখা ও অধ্যয়ন-সংক্রান্ত লিখিত লিপি মোট ১১৩ খণ্ডে প্রকাশিত হচ্ছে ও ৫৭টি খণ্ড ইতিমধ্যে প্রকাশিত হয়েছে। যেগুলো প্রকাশিত হয়নি, সেগুলির শিরোনামসহ সংক্ষিপ্তসারও প্রকাশিত হয়েছে – যে মহা প্রকল্পের সংক্ষিপ্ত নাম ‘মেগা’) এক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে ডেভিড হার্ভে তাঁর উদ্বোধনী মূল ভাষণের শিরোনাম দিয়েছিলেন, ‘পুঁজিঃ এক অসম্পূর্ণ ও চির-অসম্পূর্ণ প্রকল্প’। প্রসঙ্গত বলি লেনিনের বহু-উদ্ধৃত উক্তি ‘মার্ক্সবাদ সর্বশক্তিমান, কারণ তা সত্য’, মার্ক্সীয় মেজাজের বিপ্রতীপ। লেনিন-ভক্তরা রুষ্ট হবেন, ভেবেও দেখতে চেষ্টা করবেন না যে একথা মান্য করার অর্থ মার্ক্সের পরে আর নতুন করে ভাববার কিছু নেই, সবই মার্ক্স লিখে গেছেন।
পট্টনায়েক তাঁর প্রবন্ধের প্রথম অনুচ্ছেদেই লিখেছেন ১৮৫৯ সালে প্রকাশিত মার্ক্সের ‘রাজনৈতিক অর্থনীতির সমালোচনা সংক্রান্ত সন্দর্ভ (কন্ট্রিব্যুশন টু ক্রিটিক অফ পোলিটিক্যাল ইকনমি –মূল রচনা ইংরেজীতে) ও তার পরে ১৮৬৭ সালে প্রকাশিত ‘পুঁজি’র প্রথম খণ্ড সম্পর্কে বলেছেন, “পুঁজির উপর উপনিবেশবাদের গতিধারার প্রভাব সম্পর্কে মার্ক্সের নীরবতা প্রকট।” তিনি এও বলেছেন, ন্যু ইয়র্ক ট্রিব্যুন-এ অনিয়মিত প্রকাশিত ভারতে ব্রিটিশ শাসন নিয়ে লেখাগুলিতে উপনিবেশবাদ সম্পর্কে বললেও পুঁজি’তে এ সম্পর্কে উল্লেখমাত্র নেই। তিনি উপনিবেশগুলি (যেমন ভারত) থেকে যে উদ্বৃত্ত মূল্য উৎকলিত হচ্ছে, মার্ক্সের লেখায় খুঁজে পাননি। মার্ক্সের ‘পুঁজি’র প্রথম খণ্ড(জার্মান ভাষায়) প্রকাশের ১৫০তম বার্ষিকীতে (প্রথম প্রকাশ ১৪ সেপ্টেম্বর, ১৮৬৭) সুপণ্ডিত পট্টনায়েকের এই উক্তি বিস্ময়কর। পুঁজির প্রথম খন্ডেই মার্ক্স লিখেছিলেন - The discovery of gold and silver in America, the extirpation, enslavement and entombment in mines of the aboriginal population, the beginning of the conquest and looting of the East Indies, the turning of Africa into a warren for the commercial hunting of black skins, signalised the rosy dawn of the era of capitalist production. These idyllic proceedings are the chief moments of primitive accumulation (Karl Marx, Capital, Vol.I, 1954, London, Lawrence and Wishart, Ch.XXVI, পৃঃ ৬৬৭)। অষ্টম অধ্যায়ে শিল্পায়ন ক্ষেত্রে মার্ক্স ‘শ্রমের আন্তর্জাতিকীকরণ’ ও ‘ক্রীতদাস শ্রম’এর ‘অবাধ দেশান্তর’-এর কথা বলেছেন। অধ্যাপক মশাই ‘পুঁজি’ কি নিবিড় মনোযোগসহ অধ্যয়ন করেন নি। বিশ্বাস হচ্ছে না
বহু বিষয়ে বিরল পণ্ডিত ও মার্ক্স–চর্চাবিদ প্রদীপ বকসি পট্টনায়েকের প্রবন্ধ প্রসঙ্গে এই প্রতিবেদককে স্বরণ করিয়ে দিয়েছেন যে মার্ক্সের পরিকল্পিত কিন্তু অপ্রকাশিত খণ্ডগুলির একটি ছিল জমি সম্পত্তি, বিশ্ব বাণিজ্য ও বিশ্ব বাজার। গ্রুন্দ্রিসিতে (অর্থাৎ ‘পুঁজি’র রূপরেখা) মার্ক্স একথা সুস্পষ্ট ভাষায় লিখেছেন। পট্টনায়েক মার্ক্সের গ্রুন্দ্রিসি পড়েননি, তা হতেই পারে না। তাঁর একবারও মনে পড়ল না যে মার্ক্স ছয় খণ্ডে ‘পুঁজি’ লিখতে চেয়েছিলেন, লিখে যেতে পেরেছিলেন তিনটি খণ্ড (সেগুলির একাধিক ভাষায় অনেকগুলি খসড়া ছিল, যার প্রত্যেকটি ঔপপত্তিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ।) কাজেই তিনি এবিষয়ে অনবধান বললে তাঁর অ্যাকাডেমিক উৎকর্ষ নিয়েই প্রশ্ন জাগে।
আরও পড়ুন
২১৮,০০০ ডলারে নিলাম ‘দাস কাপিতাল’
মার্ক্সের লেখাজোখা ও অধ্যয়ন-সংক্রান্ত লিখিত লিপি নিয়ে একাধিক গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছে। এ বিষয়ে যদি প্রদীপ জানিয়েছেন, মেগার প্রকাশিতব্য চতুর্থ খণ্ডে [Exzerpte von Karl Marx (B 1-168) ] জমি সম্পত্তি, বিশ্ব বাণিজ্য ও বিশ্ব বাজার নিয়ে মার্ক্সের ভাবনা লিপিবদ্ধ আছে।
অধ্যাপক-তাত্ত্বিক মশাই-এর নিদান, উপনিবেশবাদী শোষণ সম্পর্কে অনবহিত থাকার কারণে ‘সম্পদ লুন্ঠন’ (ড্রেন অফ ওয়েলথ ) সম্পর্কে মার্ক্স জানতেন না অর্থাৎ বুঝতেই পারেননি। তিনি স্মরণ করেছেন দাদাভাই নাওরোজির ১৮৬৭ সালে প্রকাশিত ‘পভার্টি অ্যান্ড আনব্রিটিশ রুল ইন ইন্ডিয়া’। নাওরোজির বইটির প্রকাশের ১৫০তম বর্ষ স্মরণ করে প্রভাতবাবু আমাদের কৃতজ্ঞতাভাজন। কিন্তু তাঁর দাবি সে নাওরোজিই প্রথম ‘সম্পদ লুন্ঠন তত্ত্ব’ পেশ করেন এবং তাঁর উত্তরসূরি রমেশ চন্দ্র দত্ত, এক্তহায় প্রদীপ সঙ্গত কারণেই বিস্ময় প্রকাশ করেছেন, কেন সিপিআই(এম) তাত্ত্বিকের জানা নেই যে, রাজা রামমোহন রায়-এর ১৮৩১ সালে (যখন মার্ক্সের ১৪ বছর বয়েস ও নাওরোজীর সাত) প্রকাশিত দলিলের কথা – এক্সপোজিশ্যন অফ দি প্রাক্টিক্যাল অপারেশ্যন অফ দি জুডিশিয়াল অ্যান্ড রেভেন্যু সিস্টেমস অফ ইন্ডিয়া অ্যান্ড অফ দি জেনারেল ক্যারেক্টার অ্যান্ড কন্ডিশ্যন অফ ইটস ন্যাচারাল ইনহ্যাবিটেন্টস অ্যাজ সাবমিটেড টু দি অথরিটিজ ইন ইংল্যান্ড। পট্টনায়েক যদি এই বই সম্পর্কে নাও জানতেন, ১৯৬৫ সালে সোশিও ইকনমিক রিসার্চ ইন্সটুট্যূট প্রকাশিত ‘রামমোহন রায় অন ইন্ডিয়ান ইকনমি’ (সুশোভন চন্দ্র সরকার সম্পাদিত) সংকলনটি সম্পর্কে জানতেন না, ভেবে অবাক হচ্ছি। এই বইটির কথাও প্রদীপ স্মরিয়ে দিয়েছেন।
পট্টনায়েকের মতে মার্ক্স প্রধানত ইয়োরোপ নিয়েই ভেবেছিলেন। এই সিদ্ধান্তও দায়িত্বজ্ঞানরহিত, কারণ এতে উল্লসিত হবেন মার্ক্স-বিকৃতিকারকগণ যাঁরা প্রায়ই বলে থাকেন যে মার্ক্স চিন্তনে ইয়োরোপ-কেন্দ্রিক ছিলেন। প্রায় তিন দশক পূর্বে প্রদীপের ‘মার্ক্স ও এঙ্গেলস সম্পর্কে ভারতীয় লেখকেরা’ শিরোনামে (ইংরেজীতে) একটি দীর্ঘ নিবন্ধে হাওড়া স্টেশনে ১৮৬২ সালে ভারতে রেল শ্রমিকদের প্রথম ১২০০ রেল শ্রমিকদের ধর্মঘট নিয়ে ন্যু ইয়র্ক ডেলি ট্রিব্যুনে একটি লেখার উল্লেখ করেছিলেন - ধর্মঘটের দাবি ছিল দৈনিক আট ঘণ্টা শ্রমদানের সীমা বিধিবদ্ধকরণ। ইউরোপে থেকে ঐ তথ্য আহরণ মোটেই সহজ কাজ ছিল না। এটা কি মার্ক্সের ইউরোপ-কেন্দ্রিকতা প্রতিপন্ন করে ?
পুঁজি’র প্রথম খণ্ড প্রকাশের ১৫০তম বার্ষিকীর সময় (জার্মান ভাষায় রচিত গ্রন্থটি বেরিয়েছিল ১৮৬৭ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর) নীরব থেকে মার্ক্সের বিরুদ্ধে পট্টনায়েকের কল্পিত অভিযোগ মনে করিয়ে দেয় ১৮৮১ সালে ফরাসি সমাজতন্ত্রী নেতা পল লাফার্গ ও জুল গিদের প্রতি মার্ক্সের উক্তি, ‘আমি এটুকু নিশ্চিত, আমি মার্ক্সবাদী নই’। বলেছিলেন ফরাসি ভাষায়- “Ce qu’il y a de certain c’est que moi, je ne suis pas Marxiste.” (If anything is certain, it is that I myself am not a Marxist).