‘মালয়কারি’ থেকে এসেছে মালাইকারি

শাস্ত্রমতে রন্ধনবিদ্যা মহাবিদ্যা, যা পঞ্চ ইন্দ্রিয়কে স্পর্শ করে। স্বামীজি বলতেন, ‘যে ভাল রাঁধতে পারে না, সে ভাল সাধু হতে পারে না - মন শুদ্ধ না হলে ভালো সুস্বাদু রান্না হয় না।’ একই রান্না আবার হাতযশে অনুপাত আর বিন্দু অনুপাত ভেদে ভিন্ন স্বাদের হয়। দুই বাংলার অঞ্চলভেদে নানাধরনের রান্না দেখা যায়। একরকম সাদামাটা রান্নাও হাতের আটকলের কায়দায় আলাদা স্বাদের হয়। উদাহরণ স্বরূপ বলা যেতে পারে বর্ধমানের নানান ধরনের পোস্তর তরকারি আর বাঁকুড়ার পোস্তর তরকারি আলাদা আলাদা হলেও দুই-ই সমান মোহনীয়। ওপার বাংলার ঢাকা, চাটগাঁ, ময়মনসিং, রাজশাহী এবং এপার বাংলার শান্তিপুর, নদিয়া, হুগলী, বর্ধমান, বাঁকুড়া এই সব জায়গার রান্নার একটা মাহাত্ম্য আছে। তবে এই সবই যে বাঙালির নিজস্ব রান্না কৌশল এটা সম্পূর্ণ সত্য নয়।
খাদ্য অখাদ্যের বিধিনিষেধ প্রাচীন বাংলার মতো আধুনিক বাংলাতেও নেই। তাই খাদ্যাভ্যাসের ক্ষেত্রে বাঙালি ভারতের অন্যান্য রাজ্যের অধিবাসীদের চেয়ে অনেকটাই স্বাধীন। আর এর ফলেই বাঙালি খাদ্যতালিকায় মিলেছে নানা দেশবিদেশের বৈচিত্র্য। যেমন ধরুন বাঙালির অতীব প্রিয় খাদ্য চিংড়ির মালাইকারি। এই মালাইকারির ‘মালাই’ শব্দটি কোথা থেকে এসেছে এই নিয়ে মতভেদ আছে। কারণ মালাইকারিতে মালাই থাকে না। এ ব্যাপারে বিজনবিহারী ভট্টাচার্য বলেছিলেন- ‘...মালাই আসলে ফরাসি বালাহ থেকে এসেছে, যার অর্থ ঘন দুধ, ক্ষীর বা সর... কিন্তু চিংড়ির মালাইকারিতে মালাই তো থাকে না, থাকে নারকেলের দুধ...।’ এই নারকেলের দুধই কি মালাইকারির ‘মালাই’? বিশেষণের কারণ? নামটা যে উর্দুভাষী বাবুর্চিমহল থেকে এসেছে তাতে সন্দেহ নেই। হিন্দিতে মালাই (মলাঈ) শব্দের অর্থ হালকা বাদামি রং। এই রং থেকেই কারির পাশে ‘মালাই’ এর স্থান হওয়া অসম্ভব। চিংড়ি মাছ, কাটা অথবা বাটা পেঁয়াজ, আদা বাটা, লবঙ্গ, ছোট এলাচ, দারচিনি, লঙ্কাবাটা আর নারকেলের দুধ এইসব উপাদানের অনুপাত ভেদে মালাইচিংড়ি প্রায় সর্বত্র একই ভাবেই রান্না হয়। তাহলে এই মালাই শব্দটি এল কোথা থেকে। এই বিষয়ে জানতে হলে লেখিকা রোজ মেরি ব্রিসেনডেনের লেখা ‘সাউথ এশিয়ান কুকারি’ নামে একটি পুরনো রান্না বইয়ে চোখ দেওয়া যেতে পারে। এই বইতে মালয়ান, চীন ও ভারতের নানা ধরনের রান্না রেসেপির কথা লিখে গেছেন। এতে ‘ফ্রায়েড প্রন কারি’ বলে যে রান্নাটির কথা বলা হয়েছে তার সঙ্গে চিংড়ির মালাইকারির হুবহু মিল পাওয়া যায়। এখানে রান্নায় ব্যবহার করা হয়েছে পাপরিকা বা কারিপাতা। যা আবার লীলা মজুমদারের চিংড়ির মালাইকারিতেও ব্যবহৃত হয়েছে।
আরও পড়ুন
কলকাত্তাইয়া বিরিয়ানি ও নবাবি হেঁশেল
ব্রিসেনডেন রান্নাটির নামে ‘কারি’ শব্দটি ব্যবহার করেছিলেন, হয়তো কারিপাতা ব্যবহার করা হচ্ছে তাই। আর এই কারিপাতা ব্যবহার করে রান্না করেন বিশেষত দক্ষিণভারতে তামিল সম্প্রদায়ের মানুষরা। তাই বলা যায় এটি তামিল রান্না। বহু বছর আগে তামিল সম্প্রদায়ের মানুষ কর্মসূত্রে মালয়ে যান। তাঁরা হয়ত এই বিশেষ রান্নাটি সৃষ্টি করেন। এই রান্না যখন মালয় থেকে দেশে আসে তখন এর নাম মালয়কারি নামে পরিচিত হয়। আর সেই মালয়কারি দক্ষিণভারত থেকে পূর্ব-ভারতের বাংলায় প্রবেশ করে ভাষান্তরে মালয় রূপান্তরিত হয়ে মালাইকারির রূপ নেয়। আজ মালাইকারি বাঙালির রন্ধনশালায় প্রবেশ করে শ্রেষ্ঠ বাঙালি খাবারে পরিণত হয়েছে।
চলুন একনজরে দেখে নিই চিংড়ির মালাইকারির রেসেপি -
উপকরণ:
মাঝারি চিংড়ি ৫০০ গ্রাম, পেঁয়াজ মিহি করে কাটা এক কাপ, আদা বাটা আধা চা চামচ, রসুন বাটা এক চা চামচ, হলুদ গুঁড়ো এক চা চামচ, লঙ্কার গুঁড়ো এক চা চামচ, কাঁচা লঙ্কা আস্ত ১০-১২টি, নুন স্বাদ অনুযায়ী, নারকেলের দুধ এক কাপ, চিনি সামান্য, তেজপাতা দুটি, এলাচ দুটি, দারচিনি এক টুকরা।
প্রণালী :
মাছের খোসা ছাড়িয়ে ভালো করে ধুয়ে নিন। কড়াইতে তেল গরম করুন। পেঁয়াজ ও গরম মশলা একসঙ্গে ভাজুন। এবার সব বাটা ও গুঁড়ো মশলা দিয়ে ভালো করে কষাতে হবে। মশলা কষে আসলে অল্প জল দিয়ে মশলাটি আরেকটু কষিয়ে নিন। এরপর এতে চিংড়ি মাছগুলো ঢালুন এবং মশলার সঙ্গে ভালো করে কষিয়ে নিন। পরিমাণ মত নুন দিন। ভালো করে মশলা ও চিংড়ি একসঙ্গে কষা হয়ে গেলে দিয়ে দিন নারিকেলের দুধ। অল্প জ্বালে ঢেকে রান্না করুন। রান্না হয়ে গেলে ভাতের সঙ্গে পরিবেশন করুন।
(তথ্যসূত্র- ‘স্থান কাল পাত্র’, শ্রী রাধাপ্রসাদ গুপ্ত লিখিত)