চব্বিশ পরগনায় বংশ পরম্পরায় চলছে রথ বানানোর প্রস্তুতি

রথের স্মৃতি বলতেই মনে পড়ে ছেলেবেলায় ঘরে ঘরে বাচ্চাদের রথ নিয়ে আসা। দু’টাকা দিলেই হাতে চলে আসত কিছু কুচো ফুল আর নকুলদানা। যত রথ, তত নকুলদানা। এভাবে খিলখিলিয়ে উঠত শৈশব, যার ঘাটে বসলে শান্ত একটা হাওয়া আসে প্রায়ই। কিন্তু এই ছোট বড় মাঝারি রথগুলো যারা তৈরি করেন, সেই রথকারদের আমরা মনে রাখিনা। রঙবেরঙের বাহারি রথ তাঁরা তৈরি না করলে পুরো ছেলেবেলাটাই ফিকে হয়ে আসবে। এই লেখা তেমনই এক রথকারের গল্প। যিনি প্রতিবছর নিয়ম করে রথ নির্মাণ করেন আর সেই রথ পৌঁছে যায় অনেক শৈশবের ঘাটে।
রথযাত্রাকে কেন্দ্র করে প্রতিবছর বাংলায় পালিত হয় উৎসব। পারিবারিক হোক বা পাড়ার ছেলেদের টানা রথ হোক, প্রত্যেকটিই প্রায় শিল্পকলার দিক থেকে আকর্ষণীয়। এই উৎসবে ছোটদের জন্য তৈরি হওয়া কাঠের রথ একতলা থেকে তিনতলা অবধি হতে পারে। তাতে লাগানো হয় রঙিন কাগজ। দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার নুঙ্গিতে এমনই এক রথকারের সন্ধান মিলবে, যিনি রথ বানান ছোটদের জন্য। এনার নাম গোপাল মাইতি। নুঙ্গির কিস্মতে ছোট্ট একটা বাড়ি। গোপাল বাবু তাঁর বাবার কাছে শিখে এই রথ তৈরি করছেন প্রায় চল্লিশ বছর ধরে। প্রথমে গোপাল বাবুর বাবা এই ব্যবসা শুরু করলেন, তারপর এই ব্যবসা হাতে গেল ছেলে গোপালের হাতে, এখন গোপালের ছেলে আকাশও মাঠে নেমে পড়েছেন।
আরও পড়ুন
মালিক গরিব হলেও এ দোকানের চা আমিরী
গোপালদের রথের বৈশিষ্ট্য হল উজ্জ্বল রঙে নির্মিত প্রায় সবকটি রং, যেমন লাল, হলুদ, নীল, সাদা, গোলাপি, সবুজের মেলবন্ধন। প্লাইউড দিয়ে রথের মূল কাঠামো তৈরি করে তাতে প্রাইমার লাগিয়ে শুকিয়ে নেওয়া হয়। এরপর লাগানো হয় রং। ভেতরে আটকানো হয় জগন্নাথ, বলরাম, সুভদ্রার ছবি। আর থাকেন শিব, কৃষ্ণ, নারায়ণ। এটা অন্য কোনও রথে তেমন দেখা যায় না। এই রথের রং ব্যবহার দেখার মতো। গোপালরা একতলার রথ বানান না। কারণ দুই বা তিনতলা ছাড়া রঙের প্রয়োগ ঠিকমতো হয় না। রথের গায়ে এঁকে দেন সুন্দর আলপনা। চূড়ার ধরনও খানিক আলাদা। একটা ছোট চার পায়া গোল টেবিলের মতো অবয়বের উপর থাকে পতাকা।
গোপাল মাইতিদের মতো অসংখ্য রথকার এদিক ওদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছেন। আমরা তাঁদের খবর জানি না বা খবর রাখি না। কিন্তু তাঁরা তো স্বপ্নের জাদুকর। শৈশব এঁকে ফেলছেন এক নিমেষে। যে বয়স জানেনা আস্তিক নাস্তিকের পার্থক্য, যে বয়স কয়েকটা নকুলদানায় খুঁজে নেয় স্বাদ, রথ টানার মধ্যে মিলে যায় তাদের গতির রেশ, বংশ পরম্পরায় এই বয়সটাকেই ধরছেন গোপালরা। নুঙ্গির গোপালদের তাই হারিয়ে গেলে চলবে না। সোজা রথ থেকে উল্টো রথ—গোপাল মাইতিরা দাপিয়ে বেড়াবেন।