No Image

   

00:00
00:00
Volume

 0 Songs

    ৪৭ নম্বর পাথুরিয়াঘাটা স্ট্রিট এবং ‘এক যে ছিল রাজা’র গপ্প

    ৪৭ নম্বর পাথুরিয়াঘাটা স্ট্রিট এবং ‘এক যে ছিল রাজা’র গপ্প

    Story image

    নাম ছিল নুড়িঘাটা। কালেদিনে নুড়ি হয়ে গেল পাথর। সেই থেকে পাথুরিয়া। এই পাথুরে অঞ্চলকে খুঁজে পেতে বেশ চক্কর কাটতে হল। গিরিশ পার্ক মেট্রো-স্টেশনে নেমে হাঁটছি তো হাঁটছিই। সেই যে বছরদুয়েক আগে ব্রিজ ভেঙে পড়েছিল তার বেশিটাই এখনো ঠায় দাঁড়িয়ে। বেশ  ভয়ে-ভয়েই পেরোলাম সে-অঞ্চল। তারপর ডান হাতে ফিরে, খানিক গিয়ে বাঁ-হাতে ঘোরা। চায়ের দোকান, চপের দোকান, কুচো কুচো বাচ্চাদের লড়াই ঝগড়ায় ভরা রাস্তা। সেটি সোজা উঠেছে খেলাত ভবনে। শ্রী খেলাত চন্দ্র ঘোষ, যার কথা বেশ ফলাও করে লিখে গেছেন হুতোম। ৪৭-নম্বর পাথুরিয়াঘাটা স্ট্রিটের সামনে দাঁড়িয়ে সেসব মিলিয়ে দেখার চেষ্টা করছিলাম।

    সে এক রূপকথার গল্প। থুড়ি বাস্তবের রূপকথা। সে গল্পেও রাজা ছিল, প্রজা ছিল, মানুষরূপী রাক্ষস-খোক্কসের দল ছিল। সেসব আমরা চোখে দেখিনি। অথচ গল্পে-গল্পে কবে যেন তার সঙ্গে একটা গভীর যোগ তৈরি হয়ে গেছে। এই পাথুরিয়াঘাটা ঘুরে দেখলে আজও সেই গল্পগুলো একমুহূর্তে চোখের ওপর ভেসে ওঠে।

    আঠেরো-উনিশ শতকের ইমারত বুকে নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে এই অঞ্চল। শ্যাওলাধরা, নুয়ে-পড়া শরীর নিয়ে তারা আছে। ভগ্নপ্রায় ফটকে পাথুরে খোদাইয়ে নামাঙ্কণ। কে ছিল কে জানে? কিন্তু বাড়ির আকৃতিতে বোঝা যায়, একসময়ে সে বেশ বহাল তবিয়তেই ছিল। শৈশবের নগর কলকাতায় ছিল স্পষ্ট দুটি ভাগ। ট্যাঙ্ক স্কোয়্যার আর চৌরঙ্গী ছিল সাহেবপাড়া। সে অঞ্চল ধোপদুরস্ত, পরিচ্ছন্ন, সুন্দর। আর নেটিভপাড়ায় গিজগিজে ভিড়। গ্রাম থেকে দলকে দল জনতা কলকাতায় এসে একচিলতে জমিতে গড়ে তুলেছিল তাদের বসতবাটি। অন্ধকার, অস্বাস্থ্যকর, ভ্যাপসা। গ্রামীণ বসবাস ভুলে পয়সার আশায় কলকাতায় থাকতে শুরু করল তারা। তবে শুধু তো হেলাফেলার লোকেরা নয়। পাশাপাশিই ছিল মান্যিগণ্যির মানুষরাও। তারা কেউ রাজা, কেউ রায়বাহাদুর খেতাবধারী। নবাবি আমল ‘শীতের সূর্যের মতো’ অস্ত গেলেও নবাবিয়ানায় খামতি ছিল না। পাথুরিয়াঘাটা, জোড়াসাঁকো, শোভাবাজার জুড়ে ছিল তারই চিহ্ন। তোষাখানা, কাছারিবাড়ি, আস্তাবল, হাতিশাল, নাচঘর, খাসমহল – সে এক এলাহি কাণ্ড।

    শুধু পয়সা রোজগার নয়। এদের দরকার ছিল খ্যাতি। সেই খ্যাতির জন্য ভাড়া করা হত সংবাদপত্র ও সাংবাদিক। যাত্রাপালা, বাইনাচ, আখড়াই-হাফ-আখড়াইএর আসর তো ছিলই, লাখ লাখ টাকা খরচ করে চলত ছেলের বিয়ে , নাতির মুখেভাত, মায়ের শ্রাদ্ধ। ক্রিয়াকর্মের অভাব পড়লে বিড়াল-কুকুরের বিবাহ। অনুষ্ঠানে সাহেব-মোসাহেব-চাকরবাকর—প্রত্যেকের জন্য বরাদ্দ আলাদা আলাদা স্লট। কোন বাবু কতটাকা খরচ করে কত ধূম করতে পারে, তা নিয়ে রেষারেষির শেষ ছিল না।

    এই ধূমধামের প্রসঙ্গেই বিশেষ করে উঠে আসে খেলাত চন্দ্র ঘোষের নাম। হুতোমের মতে নিজের ষাট বছরের জন্মদিনে নুড়িঘাটার জমিদার খেলাত ঘোষ নাকি চোখ-ধাঁধানো মোচ্ছব করেছিলেন। সারাদিন ধরেই চলেছিল নৃত্যগীতের উল্লাস। ‘রোপড্যানসিং’ মানে দড়িনাচ ছিল দেখার মতো। বাইনাচ, বিবিনাচের পাশাপাশি রাস্তা জুড়ে আলোর রোশনাই। লালমুখো ইংরেজসহ নগরের সম্ভ্রান্ত লোকেদের ভিড়ে জমে গিয়েছিল জন্মতিথি। ঘোষ-পদবীধারী অন্যান্যদের থেকে তাঁর অবস্থান যে আলাদা, তা প্রমাণের জন্য নিজেকে খেলাত চন্দ্র দাস ঘোষ বলতেন। কেউ কেউ রসিকতা করে বলেছে, খেলাতবাবুর এ-বি-সি-ডির জ্ঞান ছিল না। তাও আমীরি দেখাতে ইংরেজি খবরের কাগজ হাতে রাখতেন। মাঝেমাঝে তা উলটো করে পড়তেনও।

    এই ঘোষ-পরিবারের আদি বাসা ছিল হুগলিতে। ওয়ারেন হেস্টিংসের আমলে পাথুরিয়াঘাটায় তাঁদের সপরিবার উঠে আসা। খেলাতবাবুর ঠাকুরদা রামলোচন ঘোষ ছিলেন হেস্টিংসের ক্লার্ক তথা পেয়ারের লোক। দেদার পয়সা করেছিলেন তাতে। পিতা দেবনারায়ণ ঘোষও তাঁর আদর্শ উত্তরাধিকারী। ৪৭ নম্বর বাড়ির মুখেই ৪৬ নম্বর বাড়িটি তাঁদের বৈভবের চিহ্ন নিয়ে আজও দাঁড়িয়ে। যদিও সে বাড়ি আজ ‘বিপজ্জনক’। খেলাত জন্মেছিলেন এবাড়িতেই। পরে, ১৮৪৬-এ তিনি ৪৭ নম্বর বাড়িটি বানান। সে এক বিশাল প্রাসাদ। সারি সারি লম্বা থাম। টানা বারান্দা। মূল ফটকের মাথায় মুখোমুখি দাঁড়িয়ে পশুরাজ সিংহ। বাড়ির ভিতরের কারুকাজও অপূর্ব। শোনা যায় বিখ্যাত মার্টিন কোম্পানি জার্মানি রীতিতে তৈরি করেছিল এই বাড়ি। যদিও দুর্গাপুজোর সময়টুকু ছাড়া সেখানে আজকাল বাইরের লোকের প্রবেশ নিষেধ। 

    এই খেলাত ঘোষ নাকি এমনিতে মানুষ বড়ো ভালো ছিলেন। দানধ্যানে নিপুণ। বহুকাল তিনি ছিলেন কলকাতার অবৈতনিক বিচারক। তাঁকে বলা হত- জাস্টিস অব পিস। উনিশ শতকের মধ্যভাগ জুড়ে খেলাত ঘোষকে নিয়ে আলোচনায় মুখর থাকত কলকাতা নগরী। এরপর খেলাতবাবুর মৃত্যু, ১৮৭৮।

    পাথুরিয়াঘাটা অঞ্চলে অবশ্য আজ আর এসব ইতিহাস কাউকে ভাবিয়ে তোলে না। গোটা অঞ্চলটাই এখন মাড়োয়ারি-অধ্যুষিত। কলকাতার এসব ছড়ানো-ঢাউস বাড়িগুলির এখন পরিচয় শুধুই রাজবাড়ি। কে, কবে কোথাকার রাজা ছিল—কে জানে? বিলাসিতা, অকারণ অতিরিক্ত ব্যয়, দেনা, সরকারি গেঁড়ো- সব মিলিয়ে রাজবাড়ির আলোগুলো নিভতে থাকে। বাসাবদল হতে থাকে একসময়ের রাজাবাবুদের।

    ৪৭ নম্বর খেলাতভবনের তাও একটা পরিচিতি আছে। প্রতিবছর দুর্গাপুজোয় বনেদি বাড়ির পুজো দেখতে এখানে জড়ো হয় উৎসাহীরা। সারাবছর ট্রাস্ট ভবনটির রক্ষণাবেক্ষণে ব্যস্ত। কিন্তু বাকিগুলি?

    সেই রাস্তায় সার দিয়ে একটাই সাইনবোর্ড। বিপজ্জনক বাড়ি! মাঝেমাঝে এই সাইনবোর্ডটিকে খুব প্রতীকী মনে হয়। কোন বিপদের ইঙ্গিত দিচ্ছে সে আসলে?

    সময় আজকাল বড়ো দ্রুত এগোয়। এই দ্রুততায় পিছন ফিরে তাকানোর অবকাশ মেলে না। ওই প্রাসাদগুলি, তার অলিন্দ, তার ছায়ায় বসে থাকা পায়রার দল একেকটা মিসিংলিঙ্ক। এই শহরের বিবর্তনের ইতিহাসে এদের ভূমিকা বড়ো কম নয়। মিসিংলিঙ্কগুলির এনডেঞ্জার্ড হয়ে যাওয়া আমাদের শহরের অস্তিত্বটাকেই ‘বিপজ্জনক’ করে তুলছে না তো?  

    Tags:

    বঙ্গদর্শনের সপ্তাহের বাছাই করা ফিচার আপনার ইনবক্সে পেতে

    @