নবনীতার রূপকথায় রানি গিয়ে উদ্ধার করে রাজাকে

নবনীতা দেবসেন
বেঁচে থাকলে আজ তাঁর ৮২ বছর বয়স পূর্ণ হত। মাত্র কয়েক মাস আগে, গত ৭ নভেম্বর তিনি আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন। যে বাড়িতে তিনি জন্মেছিলেন, প্রয়াত হলেন সেখানেই। গড়িয়াহাটের কাছে হিন্দুস্তান পার্কের বাড়ি – ‘ভালো-বাসা’। অগ্ন্যাশয়ের ক্যানসারে ভুগছিলেন অনেকদিন ধরেই। তার মধ্যেই চলছিল লেখালিখির কাজ।
আরও পড়ুন
“নারী ছলনাময়ী, জন্ম অভিনেত্রী, কিন্তু সে কি শুধু পুরুষজাতিকে মুগ্ধ করবার জন্যে?” – আশাপূর্ণা
কবি দম্পতি নরেন্দ্র দেব এবং রাধারানি দেবীর ঘর আলো করে নবনীতা জন্মেছিলেন ১৯৩৮ সালে। বাড়িতে এক মনোরম সাংস্কৃতিক পরিবেশে তিনি বেড়ে উঠেছেন। ছাত্রজীবন শুরু হয় গোখেল মেমোরিয়াল স্কুলে। প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে স্নাতক হন, পরে সেখানকার প্রাক্তনী সংসদের সভাপতির পদও সামলেছেন। স্নাতকোত্তর করেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। সেখানে বুদ্ধদেব বসু ও সুধীন্দ্রনাথ দত্তের স্নেহ পেয়েছেন। হার্ভাড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আরেকবার এমএ করেছিলেন, ডিসটিংশন নিয়ে। ইন্ডিয়ানা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্জন করেছিলেন পিএইচডি ডিগ্রি। কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়েও গবেষণা করেছেন। অমর্ত্য সেনের সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়েছিল। দাম্পত্য জীবন স্থায়ী না হলেও, দু’জনের যোগাযোগ বন্ধ হয়নি। তাঁদের দুই মেয়ে।
নবনীতা দেবসেন বহু বছর যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে তুলনামূলক সাহিত্যের অধ্যাপনা করেছেন। সামলেছেন ওই বিভাগের প্রধানের দায়িত্ব। আমেরিকার কলোরাডো বিশ্ববিদ্যালয়, ইংল্যান্ডের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস নিয়েছেন। তুলনামূলক সাহিত্যে তাঁর পাণ্ডিত্য ছিল প্রবাদপ্রতীম। বাংলা, হিন্দি, সংস্কৃত, হিব্রু, ওড়িয়া, অসমিয়া, ফরাসি, জার্মান ভাষায় তাঁর পারদর্শিতা ছিল। গবেষণা এবং অধ্যাপনার পাশাপাশি সমান তালে চালিয়ে গেছেন সাহিত্যচর্চাও। কবিতা, গল্প, উপন্যাস, ভ্রমণকাহিনি, রম্যরচনা – সবেতেই তিনি ছিলেন সিদ্ধহস্ত। ছোটোদের জন্যও লিখেছেন সাবলীলভাবে। নারী ক্ষমতায়ন আন্দোলনের সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন। সীতার দৃষ্টিভঙ্গি থেকে ‘রামায়ণ’-কে বিশ্লেষণ করেছেন। বাংলা সাহিত্যের প্রথম মহিলা কবি চন্দ্রাবতীকে নিয়ে তাঁর কাজ বিশেষ উল্লেখের দাবি রাখে। পদ্মশ্রী, সাহিত্য অকাদেমি-সহ বেশ কিছু সম্মাননা ও পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন তিনি।
‘কফি খাবেন?’ | নবনীতা দেবসেনের প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য | ভিডিও সৌজন্যে-ময়ূরিকা মুখার্জি
বেশ কিছু রূপকথার গল্প লিখেছেন নবনীতা। তবে সেগুলো গড়পরতা রূপকথার থেকে একেবারেই আলাদা। বাংলাদেশের সংবাদপত্র ‘প্রথম আলো’-কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, “…আমার রূপকথা নায়কপ্রধান নয়। আমার রূপকথায় রানি গিয়ে উদ্ধার করে রাজাকে”। ‘রূপকথা সমগ্র’ বইয়ের ভূমিকায় তিনি লিখেছেন, “…আমার রূপকথায় একটু নারীশক্তির প্রকাশ আছে। রাজা, রাজপুত্তুরেরা আর নায়ক নন, ভুল ভ্রান্তিভরা সাধারণ মানুষ। রানিরা আর রাজকন্যেরা দুর্বল নন, অসহায় নন, তাঁরাই সক্ষম। বিপন্ন হলে উদ্ধারের ব্যবস্থা নিজেরাই করতে পারেন। নিঃসন্দেহে তাঁরাই নায়ক। তাঁরা নিজেরা শত্রুজয় করেন, কিন্তু বাহুবলে নয় বুদ্ধিবলে। রাজ্য উদ্ধার করেন সুবুদ্ধির বলে। নারী-পুরুষের সামাজিক অসাম্য ঘোচাতে, নারীর আত্মনির্ভরতার প্রতি সম্মান জাগাতে এই দৃষ্টিভঙ্গি জরুরি। আমরা চাইব সমাজে ছেলেমেয়েরা সমান সম্মান, সমান সুযোগ পাক”।
নবনীতার লেখা কয়েকটি রূপকথার গল্প নিয়ে সংক্ষেপে কথা বলা যাক। ‘চন্দনরাজার বউ’ গল্পে দেখা যায়, চন্দনরাজা সারাদিন মৃত্যু কোলে ঢলে থাকেন, শুধু মধ্যরাত্রে বেঁচে ওঠেন। কয়েক ঘণ্টা পর আবার মৃত মানুষে পরিণত হন। চন্দনরাজাকে এই ভয়ংকর অবস্থা থেকে মুক্ত করেন রাজকন্যা চন্দনী। ‘পদ্ম কদম’-এ রাজপুত্র কদমকুমারকে পহ্লবী রাজার কারাগার থেকে জেলেবাড়ির মেয়ে পদ্মকুঁড়ি উদ্ধার করেন। ‘সুসনি-কল্মি’ গল্পে রয়েছে, গরিব দুই বোন ছাগলের দুধ খাইয়ে রাজার দুরারোগ্য ব্যাধী সারিয়ে দেন। দুই রাজপুত্রের সঙ্গে বিয়ে হয় সেই দুই বোনের। আবার, ‘বোকা রাজার বুদ্ধিমতী রানি’ গল্পে দেখা যায়, রাজা যতবার বেরোন যুদ্ধ করতে, রানি ততবারই স্বপ্নের গল্প ফেঁদে রাজাকে বিরত করেন। রাজকর্মচারীরা বিপদে পড়লে তাঁদের পরামর্শ দিয়ে রক্ষা করেন পাশের রাজ্যের রাজকন্যা। রানির উদ্যোগের সেই রাজকন্যা রাজার বৌমা হলেন। বিয়ের পর একদিন ওই মেয়ে তাঁর শ্বশুরকে দিয়ে অঙ্গীকার করিয়ে নিলেন, তিনি কখনও আর যুদ্ধযাত্রা করবেন না। এইভাবে নবনীতা তাঁর রূপকথার গল্পগুলোতে নারীশক্তির জয়গান গেয়েছেন।
ঋণস্বীকার –
১) ‘প্রথম আলো’-য় আহমাদ মাযহারের নেওয়া নবনীতা দেবসেনের সাক্ষাৎকার।
২) ‘রূপকথা সমগ্র’, নবনীতা দেবসেন, পত্র ভারতী।