‘এলিফাণ্টার জন্মকাল নির্ণয় করা সহজ নহে’

সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর
যিনি বোম্বায়ে বেড়াইতে আসিয়াছেন তিনি গজদ্বীপ (এলিফাণ্টা) না দেখিয়া যেন বাড়ী না ফেরেন। এলিফাণ্টার অপর নাম ঘারপুরী। এই দ্বীপে যে সকল গুহামন্দির আছে তাহা প্রস্তরময় পাহাড় খুদিয়া নির্ম্মিত। চতুর্ম্মন্দিরের মধ্যে একটীই প্রধান তাহাই বিশেষ দ্রষ্টব্য। আপলো বন্দর হইতে ষ্টীমারে করিয়া এলিফাণ্টা দ্বীপ একঘন্টায় যাওয়া যায়। বন্দর বোটে করিয়া গেলে আর একটু বেশী সময় লাগে। এই রকম একটা বোটে অনুকূল বায়ুভরে পাল তুলিয়া যাওয়াতে আরাম বটে কিন্তু বাতাস বন্ধ ও স্রোত প্রতিকূল হইলে বোটে যাওয়া আসা অনেক ঘন্টার ধাক্কা। যাত্রীদের সুবিধার জন্য বড় বড় পাথর ফেলিয়া সমুদ্রতীর হইতে গুহামুখ পর্য্যন্ত এক সোপান পথ প্রস্তুত কিন্তু ভাটার সময় নৌকা কাছে ঘেঁসিতে পারে না - তীর হইতে অনেক দূরে রাখিতে হয়। নামিবার স্থানে পূর্ব্বকালে একটি হস্তীর বিশাল পাষাণ প্রতিমূর্ত্তি ছিল তাহা হইতেই পোর্ত্তুগীস লোকেরা এই দ্বীপের নামকরণ করিয়াছে। দ্বীপে এই প্রতিমূর্ত্তির চিহ্নমাত্রও এইক্ষণে দৃষ্ট হয় না, তাহার ভগ্নাবশিষ্ট পিণ্ড বিক্টোরিয়া উদ্যানে উঠাইয়া রাখা হইয়াছে। সোপানপরম্পরা হইতে উপরে উঠিয়া গুহামন্দিরের সম্মুখস্থ প্রাঙ্গণে উপনীত হওয়া যায়। তথা হইতে কয়েক ধাপ উচ্চে উঠিলে সম্মুখে সুনীল সমুদ্র, সমুদ্রের ক্রোড়ে কশাই দ্বীপ ও দূরে অর্ণবপোতপূর্ণ বোম্বাই বন্দর পর্য্যন্ত অতি মনোহর সুন্দর দৃশ্য আবিষ্কৃত হয়। গুহার প্রবেশ দ্বারটি বেশ বড় ও সারি সারি চারি থাক স্তম্ভের মধ্য দিয়া প্রধান মন্দিরে প্রবেশ করা যায়। এই সকল স্তম্ভ প্রকাণ্ড প্রস্তরময় ছাদ-ভার বহন করিতেছে। স্তম্ভের সংখ্যা ছোট বড় মিলিয়া দ্বাচত্বারিংশৎ। তাহার কয়েকটি ভগ্নদশাপন্ন। মন্দিরের প্রবেশ দ্বার হইতে শেষ পর্য্যন্ত প্রায় ১৩০ ফীট দীর্ঘ ও পূর্ব্বদ্বার হইতে পশ্চিম দ্বার পর্য্যন্ত ততটা প্রস্থ।

এই মন্দির এইক্ষণে নিত্যনিয়মিত পূজার কার্য্যে ব্যবহৃত হয় না – যবনদের দৌরাত্ম্যে অনেক কাল পরিত্যক্ত হইয়াছে। তথাপি কোন কোন শৈব উৎসবে তথায় হিন্দুযাত্রী সমাগত দেখা যায় ও শিবরাত্রির সময় এক হিন্দুমেলা প্রবর্ত্তিত হয়। এলিফাণ্টা যে শৈব মন্দির এই মেলার প্রচলনই তাহার প্রমাণ কিন্তু তাহার আরো সুস্পষ্ট প্রমাণ মন্দিরের অভ্যন্তরেই প্রাপ্ত হওয়া যায়। ইহার মধ্যে যে সকল খোদিত মূর্ত্তি বিদ্যমান তাহার অধিকাংশ শৈব মূর্ত্তি। মন্দিরে প্রবেশ করিবামাত্র এই সকল পাষাণ মূর্ত্তি 'আধো আলো আধো ছায়া'র মধ্য হইতে দৃষ্টি পথে পতিত হয়। চতুর্দ্বারবিশিষ্ট একটী প্রকোষ্ঠে শিবলিঙ্গ প্রতিষ্ঠিত। এই প্রকোষ্ঠের বাহিরের চারিদিকে দ্বারপালগণ পিশাচের উপর ভর দিয়া দণ্ডায়মান। উত্তর দিক হইতে প্রবেশ করিয়া সম্মুখে ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বরের ত্রিমূর্ত্তি দৃষ্ট হয়। ব্রহ্মার গম্ভীর প্রশান্ত মূর্ত্তি বিষ্ণু ও মহাদেবের মধ্যে বিরাজিত। তাঁহার এক হস্তে সন্ন্যাসীর পান পাত্র। বক্ষের অলঙ্কারের শিল্পনৈপুণ্য প্রশংসনীয়। ব্রহ্মার বামে বিষ্ণু দক্ষিণ হস্তে প্রস্ফুটিত পদ্ম ধারণ করিয়া আছেন; দক্ষিণে মহেশ্বর – তাঁহার হাস্যদৃষ্টি করস্থিত ফণীফণার উপর নিপতিত। নরকপাল ও বিল্বপত্র তাঁহার শিরোভূষণ।
ত্রিমূর্ত্তির দক্ষিণে অর্দ্ধনারীশ্বর। বামার্দ্ধ গৌরী ও দক্ষিণার্দ্ধ মহাদেবের মূর্ত্তি। মহাদেবের চারি হস্তের এক হস্ত নন্দী শৃঙ্গোপরি স্থাপিত। এই মূর্ত্তির দক্ষিণে হংসবাহন চতুর্ম্মুখ ব্রহ্মা এবং বামে গরুড়বাহন বিষ্ণু। গরুড় এইক্ষণে ছিন্ন মস্তক। উপরিভাগে ও পশ্চাতে অন্যান্য দেব দেবর্ষিগণ বিরাজ করিতেছে। ইন্দ্রদেব ঐরাবত পৃষ্ঠে আসীন।
ত্রিমূর্ত্তির বামে হরপার্ব্বতীর বিশাল মূর্ত্তিদ্বয়। হরশির হইতে গঙ্গা যমুনা সরস্বতী অভ্যুদিত। মহাদেব দণ্ডায়মান – তাঁহার বাহু চতুষ্টয়ের এক বাহু জনৈক পিশাচের উপর স্থাপিত তাহার ভারে যেন সে অবনত হইয়া পড়িয়াছে। শিবের দক্ষিণে তাঁহার অন্যান্য অনুচরগণ, তদুপরি ব্রহ্মা ও শিবের মাঝে ঐরাবত-বাহন ইন্দ্র। পার্ব্বতী শিবের দিকে ঝুঁকিয়া এক পিশাচীর উপর বাম হস্তে ভর দিয়া আছেন, তদুপরি গরুড়াসীন বিষ্ণু। সর্ব্বোপরি ছয়টি মূর্ত্তি তাহার দুইটি নারী অন্যগুলি নরমূর্ত্তি।
ত্রিমূর্ত্তির আরো একটু বামস্থিত পশ্চিম প্রকোষ্ঠে হরপার্ব্বতীর বিবাহ সভায় উপনীত হইবে। একজন পুরোহিত লজ্জাশীলা বধূকে আগু বাড়াইয়া দিতেছেন।
অপর দিকের প্রকোষ্ঠে গণেশ জন্মের অভিনয়। হরপার্ব্বতী কৈলাস পর্ব্বতে একাসনে উপবিষ্ট – আকাশ হইতে তাঁহাদের উপর দেবগণ পুষ্পবৃষ্টি করিতেছেন। পার্ব্বতীর পশ্চাতে একটি বামা একটি শিশু কোলে করিয়া আছে।

দক্ষিণ হইতে উত্তর মুখে ফিরিয়া অন্য প্রকোষ্ঠে দেখিবে রাবণ কৈলাস পর্ব্বত সরাইয়া লঙ্কায় লইয়া যাইবার উদ্যোগ করিতেছেন। কৈলাস অতিদূরে অবস্থিত বলিয়া রাবণের শিব-পূজার ব্যাঘাত হয় তাই তাহা উঠাইয়া নিজ পুরীতে লইয়া যাইবার চেষ্টা। এদিকে কৈলাস পর্ব্বত কম্পমান্ দেখিয়া পার্ব্বতী ভয়ে জড়সড়। মহাদেব তাঁহার পদাঙ্গুলি দ্বারা রাবণের শিরোপরি পর্ব্বত এমন জোরে চাপিয়া ধরিলেন যে, তাহার তলে দশানন দশসহস্র বৎসর চাপা পড়িয়া থাকেন অবশেষে ব্রহ্মার পুত্র পুলস্ত্য আসিয়া তাঁহার উদ্ধার করেন।
আরও পড়ুন
যে মন্দিরে পূজিতা হন এক রাক্ষসী
ইহা হইতে পশ্চিম দিকের প্রকোষ্ঠে গমন করিলে দক্ষযজ্ঞ বৃতান্ত খোদিত দেখা যায়। অষ্টভুজ কপালমাল রুদ্রমূর্ত্তি বীরভদ্র দক্ষনিধনে নিযুক্ত – তাঁহার উপরিস্থিত একলিঙ্গের চতুর্দ্দিকে উপবিষ্ট দেবগণ হত্যাকাণ্ড সভয়ে দর্শন করিতেছেন। এই লিঙ্গের উপর একটি আকার আছে কোন কোন পণ্ডিত বলেন যে তাহা ওঁ কার প্রতিপাদক চিহ্ন।
আরো কতক পা চলিয়া গেলে প্রবেশদ্বারের কাছাকাছি মহাদেবের অষ্টভুজ ভৈরব মূর্ত্তি ও যোগাসনস্থিত মহাযোগী এই মূর্ত্তিদ্বয় দৃষ্ট হইবে।
এই সকল খোদিত মূর্ত্তি কল্পনা-যানে আমাদিগকে দেবসভায় উপনীত করে। কোথাও দ্বারপালগণ যষ্টিহস্তে পিশাচ সঙ্গে দণ্ডায়মান – কোথাও হর-পার্ব্বতীর বিবাহোৎসব – কোথাও তাঁহাদের কৈলাসে ঘরকন্না – কোথাও মহাদেব ভূতগণ সাথে তাণ্ডব নৃত্যে উন্মত্ত – কোথাও তিনি রুদ্রমূর্ত্তি কপালভৃৎ - কোথাও বা ধ্যানমগ্ন মহাযোগী – কোন স্থানে দেখিবে কমলবাহন ব্রহ্মা - কোন স্থানে শঙ্খচক্রধারী বিষ্ণু – কোথাও ঐরাবতপৃষ্ঠে ইন্দ্রদেব, গণেশ, কার্ত্তিক, কামদেব – তিলকধারী জটায়ু, কৈলাসশিখরতলে রাবণ – কোথাও গঙ্গা লক্ষ্মী সরস্বতী মূর্ত্তিমতী। দুঃখের বিষয় যে খোদিত মুর্ত্তি সকল প্রায় সকলি বিকলাঙ্গ অথবা সম্পূর্ণ রূপে অঙ্গহীন। কালের হস্তে এই মন্দির ততটা ক্ষতিগ্রস্ত হয় নাই – দুর্দান্ত মুসলমানদের অত্যাচারেও ইহার অনিষ্টসাধন হয় নাই - ইহার যে এই দুর্দ্দশা পাশ্চাত্য যবন দানবের উৎপীড়নই তাহার কারণ। এই মন্দির পূর্ণ যৌবনে যে কি সুন্দর ছিল তাহার চিত্র কল্পনাতেই রহিয়া যায়।

এলিফাণ্টার জন্মকাল নির্ণয় করা সহজ নহে। ইহার প্রবেশ পথে যে শিলালেখ্য ছিল তাহা পোর্ত্তুগীস রাজাজ্ঞায় লিসবনে প্রেরিত হয় – সে সময়ে সে লেখা পাঠ করিয়া কেহই অর্থ করিতে পারে নাই। ইহা এই মন্দিরের প্রাচীনত্বের এক প্রমাণ। সকল দিক্ বিবেচনা করিয়া ইহার বয়ঃক্রম সহস্র বৎসর অবধারিত করা যাইতে পারে।

রাত্রিতে এই গুহামন্দির আলোকিত হইলে সুন্দর দেখায়। যুবরাজ প্রিন্স্ অফ ওয়েলস্ যখন বোম্বায়ে আগমন করেন তখন তাঁহার সম্মানার্থে এলিফাণ্টা দ্বীপে এক ভোজ দেওয়া হয় সেই উপলক্ষে গুহাভ্যন্তর দীপালোকে সুন্দর রূপে রঞ্জিত হইয়াছিল। মন্দ নয়। শৈবমন্দিরে ম্লেছ ভোজ – না জানি দেবদেবীগণ কি ভাবে এই অঘোরকৃত্য নিরীক্ষণ করিতেছিলেন!
(সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'বোম্বাই চিত্র' বইয়ের ‘এলিফাণ্টা’ শীর্ষক রচনা)