No Image

   

00:00
00:00
Volume

 0 Songs

    স্বদেশে সমালোচনা সয়েই আন্তজার্তিক হয়ে উঠেছিলেন সত্যজিৎ-ঋত্বিক-মৃণাল 

    স্বদেশে সমালোচনা সয়েই আন্তজার্তিক হয়ে উঠেছিলেন সত্যজিৎ-ঋত্বিক-মৃণাল 

    Story image

    “সত্যিই আর পারছি না”, মৃদু ঠেলা দিতে জড়িত কণ্ঠে বললেন তিনি। তারপর মনের জোরেই, একরাশ ফিল্ম-ছড়ানো মেঝের ওপর থেকে উঠে বসলেন। প্রায় অমানুষিক শক্তিতে ফের লেগে গেলেন কাজে।

    ঠেলা দিয়েছিলেন সত্যজিৎ রায়। তখন ‘পথের পাঁচালি’ ছবিটি সম্পাদনার কাজ চলছিল। যিনি ঘুমিয়ে পড়েছিলেন তিনি ছিলেন ছবির সম্পাদক, দুলাল দত্ত। ঘুম পেয়ে যাওয়ারই কথা, কারণ টানা দশ দিন-দশ রাত ধরে চলেছিল ছবির এডিট। সত্যজিৎ লিখেছেন, “আমি ঐ ক’দিন চোখের পাতা এক করতে পারিনি। ...দুলাল দত্ত ঘুমিয়েছিলেন ঐ আধ ঘন্টার জন্য।” 

    ‘পথের পাঁচালি’র প্রথম প্রিন্ট যখন তৈরি হয়ে গেছে, তখন রাত কেটে আলো ফুটেছে। পরের দিন প্যান আম-এর অফিসে ছবি পৌঁছে দিতে হবে। কারণ, এখান থেকে ছবি যাবে নিউ ইয়র্কে। সেটা ১৯৫৫ সাল। সত্যজিৎ অফিসে গিয়ে কথা বলছেন রিসেপশনিস্টের সঙ্গে,। আর পারলেন না, টেবিলে মাথা রেখেই ঘুমিয়ে পড়লেন। তখন ৩৪ বছরের যুবক। ছবির কাজ শুরু হয়েছিল ১৯৫২-তে। তখন তিনি অঙ্কের হিসেবে ৩১।

    ভারতের চলচ্চিত্রের অন্যতম গর্বের মুহূর্ত এই দৃশ্যটি- দীর্ঘদেহ তরুণ পরিচালক ঘুমিয়ে আছেন রিসেপশনের টেবিলে, ছবির কাজ আড়াই বছর পরে শেষ। এরপর ছবি যুক্তরাষ্ট্রে যাবে, পরের বছর দেখানো হবে কান চলচ্চিত্র উৎসবে, পাশাপাশি বসে ছবি দেখবেন জর্জ শাদুল ও আঁদ্রে বাজাঁ। উপস্থিত থাকবেন লিন্ডসে অ্যান্ডারসন। তাঁদের দাবি উঠবে ‘পথের পাঁচালি’কে একটি বিশেষ সম্মান দেওয়া হোক। কান উৎসবে প্রথম ও এখনও অবধি একবারের জন্য ছবিটিকে দেওয়া হবে ‘শ্রেষ্ঠ মানব দলিল’-এর পুরস্কার।

    আমরা প্রত্যেকে কীভাবে যেন জেনে গেছি, সত্যজিৎ রায় ছিলেন শেষ রেনেসাঁ-মানব। আন্তর্জাতিক সম্মান পেয়েছেন, পুরস্কার পেয়েছেন। তাঁর সতীর্থ ঋত্বিককুমার ঘটক ছিলেন মাতাল ও প্রতিভাবান, এ ধরণের মানুষের যা হয়, তাই হয়েছিল, আটটা ছবি করলেও জাতীয় কিংবা আন্তর্জাতিক স্তরে তাঁকে কেউ চিনত না। সত্যজিৎ-ঋত্বিক শিবির ভাগ করাও এখান থেকে খুব সহজ হয়ে যায়!

    ইতিহাস যদিও অন্য কথা বলছে। ঋত্বিকের সম্ভবত শ্রেষ্ঠ ছবি, ‘সুবর্ণরেখা’ দেখেছিলেন ফ্রান্সে বসে জর্জ শাদুল, ১৯৬২ সালে তিনি ঋত্বিককে একটি চিঠি লেখেন। চিঠিটি এখনও দেখতে পাওয়া যায়। ছবি সম্পর্কে মুগ্ধতা প্রকাশ করে শাদুল জানান, ইউরোপীয় দর্শকদের কথা ভেবে যেন সীতার মৃত্যুদৃশ্যের আতঙ্ক যেন একটু সেন্সর করা হয়। আমাদের মনে পড়ে যাবে একের পর এক দৃশ্য, বঁটি ধরা সীতার হাত, দরজার কাছে দাঁড়িয়ে থাকা ঈশ্বর, রক্তের ছিটেয় ভরে যাওয়া সাদা পাঞ্জাবি, সীতার অবর্ণনীয় খোলা চোখের ক্লোজ আপ।

    শাদুল ভেবেছিলেন ইউরোপ এটিকে হরর ছবি ভেবে ফেলবে। ঋত্বিক কী ভেবেছিলেন? ছবিটি বিদেশে যায়নি, আজ জানার কোনো উপায় নেই কান উৎসবে ছবিটি দেখানো হলে কী হত। হয়তো ভারতের ছবির ইতিহাসটা অন্য রকম হত। এর আগেও ঋত্বিকের ছবি শাদুল দেখেছেন, সাব টাইটল ছাড়াই। ছবির নাম অযান্ত্রিক, সাল ১৯৫৬। সত্যজিৎ তখন ভেনিস জয় করেছেন, অপরাজিত কুরোসাওয়া-ভিসকন্তিদের ছবিকে পেছনে ফেলে জিতেছেন সেন্ট মার্কের ‘স্বর্ণসিংহ পুরস্কার’।

    আমাদের মনে রাখতে হবে, চলচ্চিত্র নামক শিল্প মাধ্যমটি তখন নবীন এবং আকাদেমিয়ার সর্ব স্তরে স্বীকৃত নয়। ঋত্বিক-সত্যজিৎ কিংবা তপন-মৃণালদের বিজয় ছিল ঐতিহাসিক। কারণ, তখন চলচ্চিত্রের ইতিহাস তৈরি হচ্ছে, তখন অন্য দেশে সদ্য উত্থিত হয়েছেন কুরোসাওয়া বা বার্গম্যানের মতো পরিচালক। সত্যজিৎরা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ছবিগুলির সঙ্গে, ছিনিয়ে এনেছিলেন সম্মান। এজন্যে কটু কথা শুনতে হয়েছিল স্বদেশে ও বিদেশে। কেউ বলেছেন ‘চাষাদের ছবি’, কেউ বলেছেন ‘প্রাইজ-আকাঙ্ক্ষী’। তাঁরা কান না দিয়ে শুধু মন দিয়ে ছবি করে গেছিলেন, তাঁদের কাছে ‘বাংলা ছবি’ কোনো মাপকাঠি ছিল না, একমাত্র মাপকাঠি ছিল আন্তর্জাতিকতা।

    আজ বাংলা ছবি নিয়ে শত শত কথা শোনা যায়, নির্মাতারা কেউ মনোরম দৃশ্য তুলতে বিদেশ যান, কেউ প্রবাসী বাঙালিদের ঘরোয়া চলচ্চিত্র উৎসবে ছবি দেখিয়ে আনেন। কোনো মডার্ন মাস্টার বা ক্রিটিক এই ছবিগুলি কখনও দেখেন না, নির্মাতারাও দেখাতে উৎসাহী নন। ঋত্বিক সত্যজিৎ এঁদের মতো অর্থবান, ক্ষমতাবান ছিলেন না; পথের পাঁচালি ছবিটি ক্রেনের অভাবে মাচার ওপর ক্যামেরা রেখে অনেক খানি তোলা হয়। আমাদের আন্তর্জাতিকতা শেষ, কারণ আমাদের স্থান-কালের ধারণা মৃত। আমরা দেশভাগ দেখিনি, মন্বন্তর দেখিনি, ছবিও দেখিনি।

    বঙ্গদর্শনের সপ্তাহের বাছাই করা ফিচার আপনার ইনবক্সে পেতে

    @