ইচ্ছের দৌড়- পর্ব ২

তো হ্যাঁ, আগের পর্বে যে কথা হচ্ছিল- আমায় নিয়ে লেখালেখি তো অনেক হয়েছে, সম্মান জানিয়েছন বহু মানুষ। কিন্তু আমি যে চিন্তাধারা তৈরি করেছিলাম- ভেদাভেদহীন যে সহজ পথে চলতে চেয়েছিলাম। ‘তোমার পাশে আছি’ বলে ক’জন মানুষ সেই পথে হেঁটেছেন? আজও আমার মনে আছে যেদিন ‘ত্রিধারা’ উদ্যোগ সর্বভারতীয় পত্রিকায় প্রকাশ পেয়েছে সেদিনই আমি টালিগঞ্জ থেকে গড়িয়া সাইকেল নিয়ে চারবার গিয়েছি শুধুমাত্র অনুমতির জন্য। আর এই পরিশ্রমের পাল্টা উত্তর একটাই এসেছে- ‘না’।
অনেকে হাসতে হাসতে বলেছেন আমার মহিলা ভোটার কমে যাবে। আবার অনেকে বলেছেন, “ওদের কিছু হলে আগে আমার কাছে আসবে, মিটিয়ে দেবো। তারপর বাথরুম ব্যবহার করবে। এসব স্টিকার লাগনোর দরকার নেই।” অনেকে ফোন করে বলেছেন, “কীরে হিজড়াগিরি কবে থেকে শুরু করলি?”
সব দিক যখন মিষ্টি ছুরি নিয়ে একে একে এগিয়ে আসছেন, ঠিক তখনই মা-বাবা, রঞ্জিতা সিনহা, পৌরমাতা অনিতা কর মজুমদার, দাদা বাপ্পাদিত্য মুখোপাধ্যায় এঁরা একরকমভাবে আমার পাশে থেকেছেন সবসময়। আমার আসল লড়াই কিন্তু বাথরুমে শুধুমাত্র রূপান্তরকামী মানুষদের ব্যবস্থা নয়, মানুষের ভ্রান্ত ধারণাকে পরিবর্তন করাই একমাত্র লক্ষ্য। কীভাবে আগামী প্রজন্মকে ভেদাভেদহীন একটা সমাজ উপহার দেওয়া যায় তার চেষ্টাতেই আছি। ইতিমধ্যে কলকাতার ৯০ নম্বর ওয়ার্ডের পৌরপিতা বৈশ্বানর চট্টোপাধ্যায় নিজে ফোন করে আমায় লিখিত অনুমতি দেন এবং নিজেই দায়িত্ব নিয়ে আমার আরেক উদ্যোগকে বাস্তবায়িত করেছেন। জেন্ডার সার্কেল যা ত্রিধারার সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। যেখানে ত্রিধারা ব্যবস্থা থাকবে, সেখানেই জেন্ডার সার্কেল লোগো থাকবে।
দিনের শেষে ধুলো মাখা পায়ের দিকে তাকিয়ে থাকতাম, আর নিজেকে প্রশ্ন করতাম আজ যে দৌড়ালাম, কী পেলাম? কিংবা ফোনের ওপারে কোনো সহৃদয় মানুষের প্রশ্ন, “কী করে অত মাসিদের মাঝে থাকিস?” সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে একটা কথাই বলতে চেয়েছি বারবার- তৃতীয় লিঙ্গ নয়, আমি তাঁদের মানুষ হিসাবে দেখি, তাই আমার কোনো অসুবিধা হয়না। আর তার জন্য উপহার হিসাবে তোমাদের চোখ বাঁকানো হাসি ও ব্যঙ্গ করে ডাকা ‘মাসি’রা আমায় ভালোবেসে রাখি পরায়, ভাইফোঁটা দেয়। ভাই-বোনের যে মিষ্টি সম্পর্ক ওটাই সবচেয়ে বড়ো উপহার, যা আমায় কোনো একটা অচেনা রাস্তায় অনেকদূর এগিয়ে যেতে মনের জোড় বাড়াবে।
(চলবে...)