এই রুটে আর যাবো না

সেখানে নীল আকাশের বুকে বিরাট সাদা ডানা মেলে দেয় কাঞ্চনজঙ্ঘা, একপাশে মহাকায় পান্ডিম পর্বত, তিন চেন কাং, নাম না জানা দেবতার মতো আরও কতো বরফে ঢাকা পাহাড়ের সারি। আর তার মাঝখানে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে এক বুড়ো আংলা। ভোরের রোদে প্রেক চু নদীটির রুপোর মতো জল, পাহাড় পেরিয়ে হারিয়ে যায় কোথায়।
জোংরি- গোচালা। যদি মেঘকুয়াশা না থাকে, আর যদি থাকে দু’পায়ে জোর, পশ্চিম সিকিমের এই নামকরা ট্রেক রুটের শেষ দৃশ্যটা ঠিক এরকমই। সে এক মহান সৌন্দর্য। যা গ্রাস করতে পারে আমাদের আনখ-সমুদ্দুর। তবে কেন আর যাবনা এই রুটে? এক কঠিন রাস্তা পেরোতে হয় বলে? কখনোই নয়। আমরা তো জানি, একমাত্র হিমালয়ই পারে, আমাদের শারীরিক, মানসিক আর আত্মিক, সমস্ত শক্তিকে নিংড়ে বের করে আনতে। আমরা হাসি মুখে সাড়া দিই সেই খেলায়। বিরাট পাহাড় আর ছোট্ট এক মানুষের খেলা। তবে কেন যাবনা আর?
ঐযে দেখুন, পিঠে ভারি বোঝা নিয়ে, খাড়া উৎরাই বেয়ে নেমে আসছে ঘোড়া আর চমরীর সারি। এই লেখা শেষতক কাঞ্চনজঙ্ঘা নয়, ওদেরই জন্য।
জোংরি- গোচালা ট্রেক রুটের নামডাক দুনিয়া জোড়া। ভারতের পাশাপাশি ইউরোপের নানা দেশ থেকে পায়ে হাঁটিয়ের ভিড় জমে এই রুটে। এমনকি ইজিপ্ট বা ইজরায়েলের লোকজনেরও দেখা মিলেছে এখানকার বনপাহাড়ে। ট্রেকারদের নিয়ে যাওয়া আর দেখভালের জন্য আছে নানা এজেন্সি। আট-দশদিনের এই ট্রেকের মালপত্রও বেশ ওজনদার। এমনকি অনেকের তো আবার চেয়ার- টেবিলও লাগে। তাছাড়াও ট্রেকার, গাইড-পোর্টার, এদের খাবারদাবার, তাঁবু, স্লিপিং ব্যাগ, এসব তো আছেই। আর তাই, পাহাড়ের বুকে সারি দেয় ঘামে ভেজা ঘোড়ার দল। পাথরে ক্ষুর ঠুকে এগিয়ে চলে চমরীরা। নিজের চোখে দেখেছি, রোগা একটা ঘোড়ার পিঠে দু’দুখানা গ্যাস সিলিন্ডার। পা কাঁপছে তার। খাদের পাশ দিয়ে নেমে চলেছে কোনোরকমে। যদি পা পিছলোয়, ক্ষতি যা হবে, শুধুই টাকার হিসেবে।

কাউকেই এ নিয়ে একটা কথাও বলতে শুনিনি। ব্যাঙ্গালোর বা ফ্রান্স, এখানে একই রকম উদাসীন। সবাই খালি বলে, কাঞ্চনজঙ্ঘার দেখা পেলে? যারা দেখেছে, তারা জিতেছে এই খেলা। মেঘকুয়াশায় ঢেকে গেছিল যাদের সফর, তারা হেরো।
ইউরোপীয় সংস্কৃতি মানুষ ছাড়া অন্যান্য প্রাণীদের ব্যাপারে উদাসীন। সেক্সপীয়র আর কালিদাসের তুলনামূলক আলোচনায় রবীন্দ্রনাথ দেখিয়েছিলেন, প্রকৃতি ইউরোপীয়ের কাছে প্রতিযোগী শক্তি। যেখানে, ভারতবর্ষের তপোবনে প্রকৃতি তার সংস্কৃতির অঙ্গ, তার সহায়। সেখানকার তরুলতা, হরিণশিশু আর ঋষিকুমার একই ভালোবাসার মালায় গাঁথা ফুল। এমনকি বাইবেলও, মানুষের পাপপুণ্য আর মানুষের মুক্তি নিয়েই কথা বলে। ‘শৈলশিখরে প্রদত্ত উপদেশমালায়’ যেখানে পায়রাদের প্রসঙ্গ এসেছিল, সেখানেও মানুষী বিশ্বাসহীনতার কথাই বলা হয়েছে। পাখীদের কথা নয়। ভালোমন্দের কথা বলছিনা, এ হল ধরনের কথা। আর তাই, স্পেনদেশের কবি হুয়ান রামোন হিমেনেথ, যখন প্লাতেরো নামে ছোট্ট একটি গাধার কথা লেখেন, তাকে বর্ণনা করেন ‘আশ্চর্য অনিঃশেষ স্মৃতি’ বলে, আমাদের বুক ভরে ওঠে।
কিন্তু, জোংরি- গোচালা রুটের এই পাহাড়ি পথে, দেশী-বিদেশী যে কেউ, শুধুমাত্র মানুষের সৌন্দর্য দর্শন নিয়েই চিন্তিত। হে মহাহিমবন্ত, তুমি বিরাট, তুমি আশ্চর্য। কিন্তু তুমি, ভালবাসার থেকে বড় নও।
আর তাই, আমি আর সেখানে যেতে চাইনা, যেখানে মানুষ আশ্চর্য সুন্দর কিছু দেখবে বলে, কাঁপতে কাঁপতে এগিয়ে চলে পাহাড়ের মতো বোঝা পিঠে ঘোড়ার সারি। ক্লান্ত চমরীরা থেমে যেতে চায়, আর তাদের মুখে লাগান দড়ি টেনে, জোর করে এগিয়ে যেতে বাধ্য করা হয়, দিনের পর দিন। এইসব চমরীর মালিক আর রাখাল, এদের অনেকেই যার পুজো করে, সেই শাক্যসিংহ, বলিদত্ত একটি ছাগলকে বাঁচানোর জন্য নিজের প্রাণ দিতে চেয়েছিলেন একদিন।
ঐ সব ঘোড়া, ঐ চমরীরা, আমি মনে মনে হাত বুলিয়ে দিই ওদের গায়ে। প্রণাম করি বারবার। বন্ধু, এই পথে তোমরাই সন্ত!