‘ফ্রম হাঙ্গেরি উইথ লাভ’

শূন্য থেকে ঝোলানো ছোটো-ছোটো লোহার রড। একেকটি রডে অনায়াসে পাক খাচ্ছে একেকটি শরীর।শুধু পাক খাচ্ছে না। পরস্পরের হাতে হাত রেখে পালটে নিচ্ছে অবস্থান।কখনো বা শূন্যে তৈরি হচ্ছে মানববন্ধন, গড়ে উঠছে সেতু। আর একরাশ উৎকণ্ঠা নিয়ে সেদিকে তাকিয়ে আছে দর্শক।
ট্রাপিজের খেলা। জীবন নিয়ে এই ছিনিমিনি খেলার সঙ্গে কলকাতার দোস্তি অনেকদিনের। একটা সময় ছিল, যখন শীতকাল মানেই জেমিনি সার্কাস, রয়াল সার্কাসে উপচে-পড়া ভিড়। বাঘের সঙ্গে খেলা, বলের ওপর চড়কি-পাক -- কতরকম আশ্চর্য সব খেলা। সেসব আজ প্রায় ধুকতে বসেছে।
তবে যা যায়, একেবারেই কি যায়? ইতিউতি চিহ্ন তার থাকেই।
তেমনি একটি চিহ্নের সন্ধান মিলে যায়, ১৮ নম্বর মির্জা গালিব স্ট্রিটে। কালমন কোল্ড স্টোরেজ। কালমন বা Kalman -- আমাদের বাঙালি জিহ্বা খানিক তোতলা বনে যায়। কোল্ড স্টোরেজের হঠাৎ এমন নাম-মাহাত্ম্য কেন? হদিশ করে জানা যায়, এও এক সার্কাসেরই গল্প।
সময়টা ৪০-এর দশক। দানিয়ুব উপত্যকার দেশ হাঙ্গেরি থেকে কলকাতায় আসে এক যুবক, নাম কালমন কোহারি। এমনি আসে না। পেশায় সে ট্রাপিজ শিল্পী। রাশিয়ান সার্কাসে খেলা দেখাত। সে সূত্রেই এখানে আসা। খেলাটেলা দেখানোর পরে সে আবিষ্কার করে কর্মী-ছাটাইয়ের প্রকোপে পড়ে তার কাজটি গেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ তখন বেশ জাঁকিয়ে বসেছে পৃথিবীতে।
কালমন কপর্দকশূন্য। দেশে ফেরার অবস্থা নেই। তারমধ্যে অচেনা শহর। অতএব উপায়? ট্রাপিজ-শিল্পী হার মানে না। কলকাতার মির্জা গালিব স্ট্রিটে সে খুলে বসে কোল্ড স্টোরেজ। সসেজ-সেলামি-বেকনের টানে সেখানে ভিড় জমাতে থাকে সাহেবরা।
ইতিমধ্যে স্বাধীনতার ঝান্ডা ওড়ে। কিন্তু অ্যাংলোপাড়া-ঘেঁষা কালমনের দোকানের পসার কমে না।
মির্জা গালিব স্ট্রিটে এমনিতেই রকমারি ভাষা,রকমারি জাতির মানুষের ঘোরাফেরা। সাবেক বাঙালির প্রথাগত যাপন সে চত্বরে খুঁজে পাওয়া মুশকিল। তাই হাঙ্গেরিয়ান সসেজ থেকে আরম্ভ করে বিফ স্টিক, অক্স-টাংগ সবই দেদার বিক্রি হতে থাকে কালমন সাহেবের দোকানে।
আরও পড়ুন
কলকাতা চায়নাটাউনের ‘ডন’
১৯৬৯ সাল পর্যন্ত রমরমিয়ে সে ব্যবসা চালানোর পর অবশেষে ছেদ টানে কালমন। ব্যবসায় না, জীবনে। এরমধ্যে কি একবারও দেশে গিয়েছিল কালমন? যাওয়ার চেষ্টা করেছিল? নাকি এই অচেনা শহরটাকেই নিজের করে তুলেছিল? এসবের জবাব আজ আর মেলে না। শুধু এটুকু আন্দাজ করে নেওয়া যায়, কলকাতায় সংসার বিছিয়ে বসায় এতটুকু ফাঁকি ছিল না কালমনের। শোনা যায়, তার স্ত্রী ছিল বার্মীয়। কালমনের মৃত্যুর পরে সে দোকান চালিয়েছিল বছর-দুয়েক। তারপরে হিসেবরক্ষক বিষ্ণুপদ ধরকে দোকানের দায়িত্ব বুঝিয়ে দেয় সে। আর অনুগত কর্মচারী বিষ্ণুপদ ধর কালমন সাহেবের ধারা বজায় রেখে দোকান চালিয়ে গেছে ২০১১ অবধি। বর্তমানে সে দোকানের মালিক বিষ্ণুপদর স্ত্রী রুমা ধর।
ফ্রি স্কুল স্ট্রিট বা মির্জা গালিব স্ট্রিট ধরে হাঁটতে হাঁটতে এই দোকান চোখ এড়িয়েও যেতে পারে। এমনিতে ও-অঞ্চল পুরোনো কলকাতার গন্ধে ম ম করে। রাস্তার শুরুতে বিশাল আর্মেনিয়ান কলেজ, কালমন কোল্ড স্টোরেজের একধারে ডাই করা প্রাচীন রেকর্ড, বিথোফেন থেকে পান্নালাল, নিখিল ব্যানার্জী - সবাই এক সারিতে। রয়েছে সোনালি গ্রামোফোন। অতীত নিয়ে নস্টালজিক হওয়া আমাদের স্বভাব। তাই কালমনের স্বল্পায়তন দোকানটি আরো অনেকগুলো নতুন ভাবনার জন্ম দিয়ে যায়।
গোটা ভারতবর্ষে একমাত্র এখানেই মেলে হাঙ্গেরিয়ান সসেজ। বিফ-চিকেন-পর্ক-হ্যামের নানান আইটেম একসঙ্গে এক ছাদের তলায়। সসেজ বা সেলামি আজকাল অন্যত্র পাওয়া গেলেও, এদোকানের সাথে তার ফারাক আছে। কারণ এ দোকানের খাবারে কোনো রাসায়নিক মেশে না। এমনকি আজিনা মটো পর্যন্ত ব্যবহার করা হয় না।
এমনিতে সারা বছরই ভিড় থাকে। তবে ডিসেম্বর মাস এলে তা উপচে পড়ে। তবে দোকানি জানান, আগে যেমন শুধু অ্যাংলো সাহেবরাই আসত, গত দু-দশকে সেটা একটু-একটু করে পালটেছে। আজকাল প্রচুর বাঙালি পরিবার আসে। বিফ বা হ্যাম - কোথাওই তাদের আর অরুচি নেই।
কলকাতার পুরোনো দোকানের জৌলুস ভেঙে যদিও তৈরি হয়েছে নানান বিলিতি কেতাদুরস্ত দোকান। কিন্তু পুরোনো চাল ভাতে বাড়ে। চাকচিক্যহীন বিজ্ঞাপনহীন বুড়ো কালমন আজও পিছনে ফেলে দিচ্ছে এখনকার শৌখিন সাহেবিয়ানাকে। এও এক ট্রাপিজের খেলা হয়তো। যেখানে অতীত বাস্তবতাটি ওই সামান্য লোহার রড। আর তাতেই কেমন ভেলকি দেখাচ্ছে কালমন।