No Image

   

00:00
00:00
Volume

 0 Songs

    দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের ‘দাস্য’জীবনের বিড়ম্বনা

    দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের ‘দাস্য’জীবনের বিড়ম্বনা

    Story image

    মাহবুব আলম
    ‘ধনধান্য পুষ্পভরা’ ও ‘বঙ্গ আমার জননী আমার’-এর মতো কালজয়ী সৃষ্টি, যার কৃতিত্ব সেই দ্বিজেন্দ্রলাল রায় সংক্ষেপে ডি এল রায় পেশায় ছিলেন সরকারের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট। মেদিনীপুরের সুজমুঠা পরগনায় সেটেলমেন্ট কর্মকর্তা হিসেবে স্থানীয় কৃষকদের খাজনা কমিয়ে দিয়ে ইংরেজ লেফটেন্যান্ট গভর্নরের প্রচণ্ড রোষে পড়েছিলেন তিনি। কৃতজ্ঞ চাষিরা ডি এল রায়ের ন্যায়পরায়ণতার জন্য তাঁর নাম দিয়েছিলেন দয়াল রায়।

    ১৮৮৬ সালের ডিসেম্বর মাস থেকে তাঁর চাকরিজীবনের শুরু। তাঁর ভাষায় ‘দাস্য’জীবনের বিড়ম্বনা, যার অবসান ঘটে ১৯১৩ সালে ক্লান্তি ও অপমানের মধ্যে, তাঁর মৃত্যুর তিন মাস আগে স্বেচ্ছায় অবসর নিয়ে। তাঁর স্বাধীনচেতা মনোভাব ও তেজস্বী স্বভাব ইংরেজ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে পদে পদে মতান্তর সৃষ্টি করে। ফলে অনবরত বদলি হতে হয়েছে এক জেলা থেকে আরেক জেলায়। ২৭ বছরের চাকরিজীবনে নানা প্রান্তিক অঞ্চলে বদলি হয়েছিলেন ২৫ বারেরও বেশি। কখনো কখনো বছরের এ-মাথা ও-মাথায় বদলি হতে হয়েছে তাঁকে।

    বঙ্কিম ও নবীনচন্দ্রের ভাগ্যেও বদলি-বিড়ম্বনা ঘটেছিল প্রচুর; তবে বুদ্ধি, কৌশল ও আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করে পরিস্থিতি সামাল দিতে পেরেছিলেন তাঁরা। কিন্তু আত্মাভিমানী দ্বিজেন্দ্রলাল এই অনবরত বদলিকে সহজভাবে মেনে নিতে পারেননি। এক চিঠিতে তাঁর জীবনীকার দেবকুমার রায় চৌধুরীকে লেখেন, ‘ক্রমাগত বদলি আমাকে যেন অস্থির করে তুলেছে।’ এই অস্থিরতা তাঁর সৃষ্টিশীলতাকে ব্যাহত করেছে আর মানসিক গ্লানিকে করেছে তীব্র থেকে তীব্রতর। নাবালক ছেলে দিলীপ কুমার রায়কে চিঠি লেখেন, ‘মনিবরা আমাকে ফের বদলি করলেন—দেবই এবার চাকরি ছেড়ে। আমি কি ফুটবল নাকি যে ওরা যখন যেখানে খুশি “শট” করে পাঠাবেন!’ পরিণত বয়সে ছেলে দিলীপ কুমার রায় তাঁর বাবার চাকরি প্রসঙ্গে লিখেছেন, ‘নিয়তির কী পরিহাস—স্বধর্মে যিনি কবি, স্বভাবে যিনি স্বাধীন, তাঁকেও কিনা বারবার চাকরি ছাড়ার পণ নেওয়া সত্ত্বেও চিরটা কাল ওই চাকরিতে কায়েম থাকতে হলো।’ বাবার চাকরি প্রসঙ্গে ছেলের কী বাস্তব ও নির্মোহ মূল্যায়ন!

    বিদেশি ডিগ্রি, কর্মদক্ষতা, সততা, বংশকৌলিন্য ও ব্যক্তিত্ব—চাকরিজীবনে উন্নতি করার যা যা প্রয়োজন, তার সবই ছিল দ্বিজেন্দ্রলালের। সুস্থিরভাবে চাকরি করলে তাঁর পক্ষে ম্যাজিস্ট্রেট হওয়া অসম্ভব ছিল না। তা ছাড়া সেই সময়ে হাকিমের চাকরির সামাজিক কৌলীন্য ও প্রতিপত্তি ছিল প্রবাদসম। ছেলে দিলীপ রায় লিখেছেন, ‘হলে কী হবে? তাঁর স্বভাবই হয় দাঁড়ানো তাঁর পথ আগলে। জীবিকার জন্য তাঁকে বিদেশি রাজতন্ত্রের আমলা হতে হলো, এ দুঃখ চিরদিন তাঁর মনে কাঁটা হয়ে বিঁধে ছিল।’

    মতবিরোধ ছোট লাট অর্থাৎ প্রদেশের সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেনি কখনো, প্রকাশ্য আলোচনা তো দূরের কথা। কিন্তু দ্বিজেন্দ্রলালের সঙ্গে ছোট লাট স্যার চার্লস এলিয়টের জমির খাজনা-সংক্রান্ত বিষয়ে বিরোধ প্রকাশ্যে চলে আসে এবং ছোট লাট এই মতদ্বৈধতায় ভ্রান্ত প্রতিপন্ন এবং আদালতে সমালোচিত হয়ে যারপরনাই ক্রুদ্ধ ও অপমানিত বোধ করেন।

    সরকারি জরিপ বিভাগে কাজ করার সময় মেদিনীপুর জেলায় জমি সেটেলমেন্ট করতে গিয়ে দ্বিজেন্দ্রলাল একটি বিচিত্র ব্যবস্থার হদিস পেলেন। ওই এলাকায় জমি বন্দোবস্ত দেওয়ার সময় কোনো সঠিক মাপজোখ করা হতো না। আন্দাজে জমির পরিমাণ ধরে নিয়ে জমি বন্দোবস্ত ও খাজনা ঠিক করা হতো। নতুন বদলি হয়ে আসা সেটেলমেন্ট অফিসাররা প্রত্যেকই আবার নতুন করে জমি মেপে বেশি জমি আছে এই যুক্তিতে খাজনা বাড়িয়ে দিতেন। তিনি নিজেই ঘটনাটি লিখে গেছেন। তাঁর বয়ানেই শোনা যাক পুরো বিষয়টি, ‘আমি এই অভিপ্রায় প্রকাশ করি যে এরূপ খাজনা বৃদ্ধি অন্যায় ও আইনবিরুদ্ধ…রাজা যদি বেশি জমির জন্য বেশি খাজনা দাবি করেন, তবে তাহার দেখাইতে হইবে যে প্রজা কোন বেশি জমিটুকু অধিকার করিয়াছে। আরও সেচের খাল বন্ধ হওয়ায় জমির বাৎসরিক ফসল কম হইয়া যাওয়ায় আমি প্রজাদিগের খাজনা কমাইয়া রায় দেই। ওই রায় হইতে জজের নিকট আপিল হয় এবং তাহাতে জজ সাহেব আমার রায় উল্টাইয়া দিয়া প্রজাদিগের খাজনা বৃদ্ধি করিয়া দেন।’

    বাংলাদেশের ছোট লাট স্যার চার্লস এলিয়ট এ বিষয়ে তদন্ত করতে নিজে মেদিনীপুরে এসে কাগজপত্র দেখে দ্বিজেন্দ্রলালকে ভর্ৎসনা করেন। ‘আমি আমার মত সমর্থন করিয়া বঙ্গদেশীয় সেটেলমেন্ট আইন বিষয়ে তাঁহার (ছোট লাট) অনভিজ্ঞতা বুঝাইয়া দেই।’ স্বয়ং ছোট লাটকে আইন অনভিজ্ঞ বললে একজন সামান্য ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটের চাকরি বিপদাপন্ন হবে, এ তো স্বাভাবিক। এরপর হতাশ দ্বিজেন্দ্রলাল প্রকাশ্যে ব্যঙ্গ করে বলে বসলেন, অনেস্টি ইজ নট দ্য বেস্ট পলিসি। ম্যাজিস্ট্রেট তাঁকে রেগে তলব করেন আর তাঁর চাকরিচ্যুতির বন্দোবস্ত করতে নেমে পড়লেন। ডি এল রায়ের কপাল ভালো। ইতিমধ্যে হাইকোর্টে প্রজাদের আপিলের জবাবে দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের রায় বহাল রাখার আদেশ হয়। তিনি পদচ্যুতির আশঙ্কা থেকে রেহাই পেলেন। আদালতে রায়ের কাছে মাথা নত করলেও ছোট লাট দ্বিজেন্দ্রলালের সার্ভিস বুকে লিখিত মন্তব্য করলেন, ‘দ্বিজেন্দ্রলাল শ্রমবিমুখ ও অলস’ কিন্তু তাঁর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা দৃঢ়ভাবে দ্বিজেন্দ্রলালকে সমর্থন করে তাঁর রিপোর্টে লিখলেন যে ‘তিনি কাজ, পরিশ্রম ও দক্ষতায় কীর্তিস্তম্ভস্বরূপ।’ কিউনিফেন তাঁর পাশে না দাঁড়ালে দ্বিজেন্দ্রলালের পদচ্যুতি অবধারিত ছিল। ছোট লাট তাঁর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিতে না পারলেও প্রকৃতপক্ষে তাঁর উচ্চতর পদে প্রমোশন বন্ধ করে দিলেন।

    দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের কী প্রতিক্রিয়া হয়েছিল, তা দেখা যাক। এবার তিনি লিখে গেছেন, ‘আমি সত্যই ইহা শ্লাঘার বিষয় বিবেচনা করি যে আমি ক্ষুদ্র ক্ষমতাতেই উক্ত রায়ে নিজের পায়ে কুঠারাঘাত করিলেও সমস্ত বঙ্গদেশব্যাপী একটি উপকার সাধিত করিয়াছি—নিরীহ প্রজাদিগকে অন্যায় কর বৃদ্ধি হইতে বাঁচাইয়াছি।’

    সরকারি কর্মচারী হয়েও তিনি স্বদেশি আন্দোলনের আমলের আগুনের আঁচে জর্জরিত হয়ে ‘বঙ্গ আমার জননী আমার’ গানটিতে লিখে বসেছিলেন, ‘আমরা ঘুচাবো মা তোর কালিমা হূদয় রক্ত করিয়া শেষ।’ পরে সুহূদদের পরামর্শে এই উত্তেজক বিদ্রোহমূলক পঙিক্ত বদলে লেখেন, ‘মানুষ আমরা নাহি তো মেষ।’ বন্ধুদের পরামর্শে আরও সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নিলেন। স্বদেশি আন্দোলন উপলক্ষে লেখা দেশাত্মবোধক সংগীতগুলো সব পুড়িয়ে ফেললেন। পরে আরও সংহত হয়েছিল তাঁর অনুভূতি। রাজশক্তির সঙ্গে প্রত্যক্ষ সংঘর্ষে যাওয়া তিনি সরকারি কর্মচারী হয়ে সমীচীন মনে করেননি।

    শেষে চাকরির প্রতি তাঁর হয়তো আর তেমন আকর্ষণ ছিল না। ২৫ বছর পূর্ণ হলে স্বেচ্ছা অবসর নেওয়ার কথা প্রায়ই তাঁকে বলতে শোনা যেত। ‘বেশ একটা নতুন ধরনের আইডিয়াল (আদর্শ) মাসিক কাগজ বের করার ইচ্ছে ছিল দ্বিজেন্দ্রলালের অবসরের দিনগুলোয়। ভারতবর্ষ-এর সম্পাদক হওয়ার সব ব্যবস্থাও সম্পন্ন হয়েছিল। অবসরের সরকারি অনুমোদন হয়ে না আসায় নিজের নাম সম্পাদক হিসেবে দেওয়া যথোচিত মনে হয়নি তাঁর। কিন্তু রাজপুরুষের অনুমতি আসার আগেই পৃথিবীর সম্রাটের ডাক এসে গেল। ৫০ বছর বয়সে স্বেচ্ছা অবসরের তিন মাস আগে ১৯১৩ সালে অকস্মাৎ তিনি মারা যান।

    এই তিন ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট স্বাধীনচেতা হলেও তাঁরা ছিলেন রাজভক্ত। চাকরির বিধিনিষেধের লক্ষণরেখা কখনো উপেক্ষা করেননি। ঔপনিবেশিককে কাঠামোর সঙ্গে তাল মেলাতে গিয়ে তাঁদের বিরোধী সত্তাকে সময় সময় সমঝোতা করতে হয়েছে। চাকরিজীবনে হতাশা, স্বীকৃতির অভাব ও অসম্পূর্ণতা সত্ত্বেও তাঁদের সৃজনশীলতায় কখনো ভাটা পড়েনি। যে কালজয়ী সৃষ্টি তাঁরা রেখে গেছেন, আজও তা ভাস্বর হয়ে রয়েছে।

    (ঋণ – বাংলা লাইব্রেরি)

    বঙ্গদর্শনের সপ্তাহের বাছাই করা ফিচার আপনার ইনবক্সে পেতে

    @