No Image

   

00:00
00:00
Volume

 0 Songs

    ইতালিয়ান কলকাতার দিনগুলি রাতগুলি

    ইতালিয়ান কলকাতার দিনগুলি রাতগুলি

    Story image

    ‘হরি দিন তো গেল, সন্ধ্যা হল/ পার করো আমারে...’ – কলকাতার তিলোত্তমা হয়ে ওঠার পর্বে ক্রমশ ফিকে হয়ে এসেছিল এই পারাপারের দুশ্চিন্তা। সূর্যের আলোর দিন ফুরোলেই বিজলি আলোর দিন শুরু। আর দিনই যখন, তখন আর ঘরে বসে থাকা কেন! কাজকম্মের শেষে সাহেব, মোসাহেব, বাবু সবারই অন্য জীবন আরম্ভ। অপেরা, থিয়েটার তো বটেই, বাগানবাড়িতে, হোটেলঘরেও চলত নাচানাচির লম্ফঝম্প, শ্যাম্পেইনের ফোয়ারা, দেদার খানাপিনা, রঙ্গরসিকতা। কলকাতায় আজকের মতো তো প্রতি মোড়ের মাথায় রেস্তোরাঁ ছিল না তখন। তাই হাতে-গোনা কয়েকটিতেই উপচে পড়ত মানুষ।

    কলকাতার প্রথম যুগের হোটেল-রেস্তোরাঁতে এদেশীয় লোকেদের প্রবেশ অবাধ ছিল না। কেউ যদি প্রবেশাধিকার পেতও, তাকে হতে হত রাজা-মহারাজা ক্যাটেগরির। গ্রেট ইস্টার্ন (আজকের ললিত গ্রেট ইস্টার্ন), গ্র‍্যান্ড (আজকের ওবেরয় গ্র‍্যান্ড)-- এই হোটেলগুলির জৌলুস ছড়িয়ে পড়ত রাস্তায়। শুধু বাইরের চাকচিক্য নয়। খাবারের মান থেকে শুরু করে তার পরিবেশন,  আনুষঙ্গিক সমস্ত কিছুই ছিল ইউরোপীয় প্রথা মেনে অত্যন্ত রুচিসম্পন্ন। কলকাতার পুরোনো দিনের হোটেল বলতে গ্র‍্যান্ড বা গ্রেট ইস্টার্নের কথাই মূলত মনে পড়ে। তবে, বিশ শতকের দোরগোড়ায় আরেকটি ইতালিয়ান হোটেলও তাক লাগিয়ে দিয়েছিল কলকাতাবাসীদের।

    বাঙালির কাছে ‘ইতালিয়ান’ বলতে একসময় ছিল মূলত সেলুন। রাস্তার পাশে ছুড়ি-কাঁচি আর একটা আয়নাকে সম্বল-করা সেসব সেলুনে কম পয়সায় কাজ হাসিল হত। কিন্তু, তারও বেশকিছু বছর আগে থেকে কলকাতাকে ইতালির স্বাদ দিয়েছিল দুজন ইতালিনিবাসী। 

    ফেদ্রিকো পেলিটি এবং অ্যানজেলো ফিরপো

    আজ ওপেন মার্কেটের যুগে যদিও লোকের কাছে পিৎজা বা পাস্তা নামগুলি অপরিচিত নয়। অবশ্য, সেইসবের অরিজিনালিটি নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায় বৈকি। ১৮৭২ সালে ফেদ্রিকো পেলিটি নামের এক ব্যক্তি যখন সুদূর ইতালি থেকে ভারতে এসে একটি বেকারি৩ তৈরি করেন, তখনো কিন্তু ইতালিয় স্বাদের মর্ম বুঝত না কলকাতাবাসী। ফেদ্রিকো শেখালেন খাঁটি ইতালিয় স্বাদ কাকে বলে। আর, সেই যে শেখালেন, কলকাতার জিনে লেখা হয়ে গেল ইতালিয় পদের পদ্য।

    যেমন-তেমন করে কিন্তু আসেননি ফেদ্রিকো। রিচার্ড বুর্ক, যিনি ছিলেন ভি আর্ল অব মায়ো, তাঁর একজন সুপটু শেফের দরকার পড়ে। কীভাবে পটুত্ব বোঝা যাবে? প্রতিযোগিতা হয়, আর তাতে জিতে যান ফেদ্রিকো। সেটা ১৮৬৯ সাল।

    পেলিটির বেকারি

    কলকাতায় এসে ফেদ্রিকো ৪১ নম্বর বেন্টিঙ্ক স্ট্রিটে তাঁর প্রথম বেকারিটি তৈরি করেন। কলকাতার বুকে প্রথম ইতালিয় বেকারি। নাম হয়- ‘ও'নিল এন্ড পেলিটি’। তারপর, ১৮৭৫-এ নতুন রেস্তোরাঁ ১৮/১, চৌরঙ্গীতে। ইতিমধ্যে, ফেদ্রিকো বিখ্যাত তো হয়েছেন বটেই, কয়েকটি প্রতিযোগিতায় জুটেছে গোল্ড মেডেলও। তাঁর পাউরুটিকে ঘিরে বেশ হাঁকডাক। সিমলাতেও অর্থাৎ ব্রিটিশ সরকারের গ্রীষ্মকালীন রাজধানীতেও তাঁর ব্যবসা ছড়িয়েছে। সেখানেও বিপুল খ্যাতি পেয়েছেন এই সুপুরুষ, শৌখিন মানুষটি। ভাইসরয়, মহারাজা, গভর্নরদের ভিড় লেগেই থাকে সেখানে। এরপর, নিজের ভালোবাসার শহর কলকাতার এসপ্ল্যানেডে একটি রেস্তোরাঁও খোলেন ফেদ্রিকো।

    ফিরপো রেস্টুরেন্ট

    তাঁরই সুযোগ্য শিষ্য ছিল ইতালির জেনোয়া-নিবাসী অ্যানজেলো ফিরপো। ১৯১৭ সালে, প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন তিনি চৌরঙ্গীতে তৈরি করেন বিশুদ্ধ ইতালিয়ান রেস্তোরাঁ,  নাম- ‘ফিরপো’জ’। সে সময় কলকাতায় ভিনদেশি সৈনিক, মিলিটারির সমাগম। ফিরপোতে ভিড় জমায় তারা। অচিরেই খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে সর্বত্র। কলকাতার ব্রিটিশদের নিত্য যাতায়াত তো থাকতই, বাদ পড়তেন না নেপালের মহারাজাও। ভাইসরয় ও গভর্নর জেনারেল লর্ড আরউইনের খাবারের প্রিয়তম স্থান ছিল ফিরপোর হেঁসেল। প্রতি রবিবারই নাকি লাঞ্চের সময়ে তিনি ঢুঁ দিতেন সেখানে। 

    ফিরপো রেস্টুরেন্টের পুরোনো মেনু চার্ট

    ফিরপোর রেস্তোরাঁয় সরঞ্জাম কম ছিল না। ভারতের একমাত্র স্প্রাং-ফ্লোরে নাচের লহরি উঠত। অর্কেস্ট্রা, ট্রাম্পেট, স্যাক্সোফোনে জমে উঠত মজলিস। আর হ্যাঁ, ‘আ লা কার্টে’ মেনু রাখতেন না ফিরপো। প্রতিদিনের সেট মেনুই ছিল তাঁর বৈশিষ্ট্য।

    মিস শেফালি

    স্বাধীনতার পরে, ৬০-এর দশকে ফিরপোর লিডো রুম কাঁপাতেন ক্যাবারে ডান্সার মিস শেফালি। রাতের মেহফিলে তখন উপচে পড়ছে রোশনাই।

    ‘আমাদের গেছে যেদিন, একেবারেই কি গেছে...?’ 

    কিছু কিছু দিন একেবারেই যায়। ফিরপোর বিখ্যাত পাউরুটি, কেক-পেস্ট্রি, বড়োদিনের হল্লা একদিন হঠাৎই ফুরিয়ে যায়। কলকাতা থেকে অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানরা পাততাড়ি গোটাতে শুরু করে। ফিরপোর কর্তৃপক্ষ রেস্তোরাঁয় আর লাভের মুখ দেখতে পায় না। সরকারের কাছে তারা আর্জি জানায়, তাদের রেস্তোরাঁকে মার্কেট বানিয়ে দেওয়ার। আর্জি মঞ্জুরও হয়। তবে, তাতেও ভয়াবহ আগুন লাগে ২০০২ সালে।

    কলকাতায় এ এক আশ্চর্য ব্যাপার। বহু পুরোনো নিদর্শনই আগুনে পুড়ে একেবারে নেভে। ফিরপো নামটি অবশ্য আজও আছে। শাড়ি জামাকাপড়ের দোকানের সঙ্গে জুড়ে। মূল কাঠামোটি বদলে গেছে একেবারেই। 

    কলকাতার খাদ্যাভ্যাসের ইতিহাস লিখতে গেলে ফিরপোর নাম অবশ্যই বলতে হয়। বড়োদিনের কেক পেস্ট্রি তো বটেই। সর্বোপরি, পাঁউরুটি-- যা প্রায় বাঙালির জাতীয় খাদ্য হয়ে উঠেছে, তাতেও ফিরপোর অবদান প্রাতঃস্মরণীয়।

    Tags:

    বঙ্গদর্শনের সপ্তাহের বাছাই করা ফিচার আপনার ইনবক্সে পেতে

    @