No Image

   

00:00
00:00
Volume

 0 Songs

    দার্জিলিং ও একটা পাইন-ঘেরা পাহাড়ি ক্যাফের গপ্পো

    দার্জিলিং ও একটা পাইন-ঘেরা পাহাড়ি ক্যাফের গপ্পো

    Story image

    ম্যাল থেকে বাঁ-হাতের রাস্তাটা সোজা চলে গেছে ভানুভবন ও চার্চ ছুঁয়ে রাজভবনের দিকে। এই রাস্তায় পা রাখার মুখেই কলোনিয়াল হোটেল উইন্ডামেয়ার। এর আগে ম্যালের সবুজ বেঞ্চ, পাতলা কুয়াশায় মোড়া জাপানি পেইন্টিং-এর মতো সাদা ঘোড়া, তার বুড়ো সহিস, হঠাৎ হঠাৎ ডানা ঝাপটিয়ে উড়ে যাওয়া পায়রার ঝাঁক, অক্সফোর্ড, রঙিন উলের সোয়েটার। এসবের বুনে দেওয়া নেশা জড়িয়েই আপনি হাঁটা লাগালেন চার্চের দিকে। চার্চ থেকে পাইন ঘেরা রাস্তা ধরে কয়েক-পা হাঁটতেই রাজভবন। ডান দিকে বেঁকে যাওয়া রাস্তাটা মহাকাল মন্দির ছুঁয়ে ফের মিশেছে ম্যালে। রাজভবনের পাশেই ইতি-উতি বেঞ্চি সাজানো। সেখান গিয়ে দাঁড়ালেই আকাশ-জুড়ে মহারাজকীয় কাঞ্চনজঙ্ঘা।

    ক্যাফেতে যাওয়ার পথ

    কিন্তু আপনি ও-পথে যাবেন না এখন। বরং রাজভবনকে ডান দিকে রেখে রিচমন্ড হিল ধরে চলুন চিড়িয়াখানার দিকে। আপনার বাঁ-হাতে গাছ-গাছালির ফাঁক দিয়ে চোখে পড়বে পাহাড়ে শুয়ে থাকা দার্জিলিং শহর। এই রাস্তার ঘোর আপনাকে পেয়ে বসবে ক্রমশ। পাথুরে দেওয়ালে ফার্ন, পাইনের পাতা, কবেকার বৃদ্ধ দাদামশাই যেন এরা। এই পথ দিয়ে এগোলেই চোখে পড়বে দার্জিলিং-এর সিমেট্রি। ভগিনী নিবেদিতা শায়িতা এখানে। শায়িতা এককালের ব্রিটিশ আর্মির বেশ কিছু সৈনিক। না যুদ্ধে না, এঁদের বেশিরভাগেরই মৃত্যুর কারণ আত্মহত্যা। কুয়াশা, মেঘ, খাদে সাজানো এই শহর বড় অবসাদের ঠেকত সমুদ্র পেরিয়ে আসা বিদেশিদের কাছে। সেই ইতিহাসও এখানে শায়িত।

    ক্যাফের ভিতরে

    আর, সেই সিমেট্রির ঠিক আগেই একটি আটপৌরে ক্যাফে। হট স্টিমুলেটিং ক্যাফে। তিন-কোণা পাহাড়ি চালার একটি ঘর, ঘরের লাগোয়া ঝুলন্ত ছাদ-বারান্দা। সেখানেও বসার টেবিল পাতা। আপনাকে অদ্ভুত আকর্ষণে টানবে এই ক্যাফে। দরজা দিয়ে ঢুকলেই দেখবেন কোনও এক টেবিলের ওপর গুটিসুটি মেরে বসে আছে বাদামি বিড়াল। পাশের টেবিলে ধোঁয়া-ওড়ানো কফিতে চুমুক দিয়ে নিজেদের মধ্যে আড্ডা জুড়েছে দুজন ইউরোপীয় যুগল। এই ক্যাফের মেজাজটাই যে আলাদা, বুঝতে আপনার সময় লাগবে না বিশেষ।

    ক্যাফের ভিতরে

    দু-পাশের দেওয়াল-জোড়া জানলা। সেখানে মাঝেমাঝেই বিশ্রাম নিতে দু-দণ্ড বসে কুয়াশারা। আপনি ততক্ষণে অর্ডার করেছেন কফি, চিজ ওমলেট ও মোমো। ক্যাফে চালান দুই ভাই-বোন। রুম্বা আর তাঁর দিদি লিলি। নেপালি, তিব্বতি আর চাইনিজ খাবার মেলে এখানে। মোমো কিংবা থুপ্পা--- অর্ডার করলেই টেবিলে চলে আসবে গরম-গরম। সঙ্গে কফি, ধোঁয়া-ওড়ানো চা। এছাড়াও মিলবে আরও হরেক খাবার--- নুডলস, চিকেন ওমলেট, চিজ বার্গার। দামও আকাশছোঁয়া নয় মোটেও। বরং, নানা হালের ক্যাফের তুলনায় বেশ কম। এবং, দোকান-মালিক সুলভ কোনও তাড়াও নেই রুম্বা আর লিলির। আপনি যতক্ষণ খুশি বসে খান, আড্ডা দিন, চুপ করে বসে থাকুন এই পাইন, পাহাড়-ঘেরা ছোট্ট ক্যাফের ভিতর। আপনার ভিতরেও জমা হোক অকারণ মেঘ। বাইরে হয়ত বৃষ্টি নেমেছে। আপনি কফির দাম মিটিয়ে ফিরতে চাইলে আপনাকে আটকাবেন রুম্বা। বাইরে বৃষ্টি, আরেকটু থেকে যান। তার কোলে ততক্ষণে উঠে বসেছে সেই আদুরে গম্ভীর বিড়াল। ক্যাফের চাতালেই শুয়ে একটা অ্যালশেশিয়ান। নতুন অতিথি ক্যাফের সংসারে। খাবারের দাম মেটানো হয়ে গেছে। তাও, এই আন্তরিক ডাক আপনি ফেরাতে পারবেন না। রুম্বার দিদি আপনাকে জিজ্ঞেস করবেন কফি কেমন লেগেছে? আপনি চিজ ওমলেটের প্রশংসা করলে সহজভাবে হাসবেন। আপনি ভালো না বেসে পারবেন না এই পাহাড়ি মানুষদুটিকে।

    রুম্বা ট্রেকিং ভালোবাসেন। ২০০০ সালে নিজেদের একটা ছোটোখাটো ট্রেকিং এবং ট্যুর কোম্পানিও খুলেছেন। সান্দাকফু ট্রেক করতে গিয়েই একবার সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিলেন বালুকে। ছোট্ট ফুটফুটে একটা কুকুর-ছানা। সেই বালুই এরপরে হয়ে উঠল দার্জিলিং-এর অন্যতম বিখ্যাত কুকুর। লিলির পিছু নিয়ে চলে যেত চকবাজার। ঘুরে বেড়াত ম্যালেও। কোনও কুকুর কিচ্ছুটি বলত না বারবার নিজের এলাকার সীমানা ডিঙোনো বালুকে। চেহারাটাও ছিল দেখার মতো। গায়ে পুরু লোম। কিন্তু অদ্ভুত মায়াবি স্বভাব। শান্ত, আদুরে। বালুকে দার্জিংল-এর মানুষরা ডাকতেন ‘হোলি ডগ’ বলে। কারণ, বালু নাকি প্রতি কৃষ্ণপঞ্চমীতে নিজে-নিজেই চলে যেত মন্দিরে। সারাদিন উপোস করত। সত্যি-মিথ্যে-কল্পনার যুক্তিজাল এখানে অর্থহীন হয়ে আসে। বালুকে ঘিরেও কখন গড়ে ওঠে মিথের কুয়াশা। জনপ্রিয়তা এমনই, যে বিলিতি পর্যটকদের ডকুমেন্ট্রিতেও ঠাঁই পেয়েছিল এই ক্যাফে আর বালু। তবে, এখন আর বালুকে দেখতে পাবেন না দার্জিলিং গেলে। এই মার্চেই একটা বেপরোয়া গাড়ি প্রাণ কেড়ে নিয়েছে তার। সেদিন সারা রাত তার মাথার কাছে বসেছিলেন রুম্বা আর লিলি। বসেছিল তাদের আরও দুই বিড়াল। বালু চলে যাওয়ার অল্প কদিনের মধ্যে আশ্চর্যভাবে মারা গেল বিড়ালদুটোও। লিলি বলছিলেন, বালুই ডেকে নিল ওদের...

    বালু

    রুম্বা আর লিলি ঠিক করেছিলেন আর কক্ষনও কুকুর-বিড়াল পুষবেন না। কিন্তু, সেই প্রতিজ্ঞা রাখতে পারেননি দুজনের কেউই। ক্যাফেতে ফের আনাগোনা বেড়েছে লোমশ চার-পেয়ে আদুরে পোষ্যদের। মাঝে কদিন খুব মনমরা হয়ে থাকার পর ফের নিজের মেজাজে ফিরছে এই ক্যাফেও। এখনও চিড়িয়াখানার দিকে যেতে যেতে পাইন-ঘেরা এই ছোট্ট ক্যাফের ভিতর থেকে কানে ভেসে আসতে পারে গিটারের সুর। হয়ত উঁকি মেতে দেখবেন একটা লোমশ উলের বিড়াল বসে টেবিলে আর লিলি ট্রেতে করে কফি ও মোমো দিচ্ছেন দুই বিদেশি যুবককে। তাদের সামনে বসে গিটারে কর্ড বাজাচ্ছেন রুম্বা স্বয়ং।

    গ্যারান্টি, দেখে আপনার মনে হবেই— বসে যাই...  

    কীভাবে যাবেন?
    এনজেপি স্টেশন বা বাগডোগরা থেকে গাড়িতে দার্জিলিং। সেখানে ম্যালের পাশ দিয়ে ভানুভবন। সেখান থেকে রাজভবনের পাশ দিয়ে চিড়িয়াখানার দিকের রাস্তা ধরে এগোলেই পড়বে এই ক্যাফে।

    কী কী খাবেন?
    নেপালি, তিব্বতি ও চাইনিজ খাবার। মোমো, নুডলস, চিজ ওমলেট ও আরও নানা কিছু। সঙ্গে চা/কফি তো আছেই।
    ক্যাফে খোলা প্রতিদিন সকাল ৮টা থেকে সন্ধে ৭টা।

    বঙ্গদর্শনের সপ্তাহের বাছাই করা ফিচার আপনার ইনবক্সে পেতে

    @