No Image

   

00:00
00:00
Volume

 0 Songs

    বাংলায় সঠিক বানান লেখার দায় কাদের?  

    বাংলায় সঠিক বানান লেখার দায় কাদের?  

    Story image

    ঘটনাটার সূত্রপাত এইরকম। পরিচিত এক বন্ধুর শিশুপুত্র ভর্তি হয়েছিল পাড়ারই এক কিন্ডারগার্টেন স্কুলে। ঘটনাচক্রে, ইংরিজি মাধ্যম হলেও সেই স্কুলে তখনও ‘সহজপাঠ’ পড়ানোর চল ছিল – সময়কালটা এখন থেকে পনেরো-ষোলো বছর আগের। যেহেতু ‘সহজপাঠ’ পড়ানো হয়, ফলে তাঁর বাবা-মা ধরেই নিয়েছিলেন তারই সূত্রে বুনিয়াদী বাংলা ভাষার একটি সাবলীল চিত্র তাঁদের একমাত্র পুত্রের সামনে ধরা পড়বে – এই প্রত্যাশায় কোনো বড়ো গলদ ছিল বলে মনে হয় না। কিন্তু গোল বাধল যখন সেই ‘সহজপাঠ’ থেকে হোমটাস্ক দেওয়া হল সেই শিশুটিকে। দিদিমণি খাতায় প্রশ্ন লিখে দিলেন, “পাখি কি খায়?” এর উত্তরটি বাড়ি থেকে ‘সহজপাঠ’ পড়ে তাকে খাতায় লিখে নিয়ে আসতে হবে। সরলমতি শিশুটি বাড়িতে মা কিংবা বাবার সহায়তায় সেই প্রশ্নের জবাব লিখল, “হ্যাঁ। পাখি দানা খায়”। কিন্তু খাতা দেখতে গিয়ে বাংলার দিদিমণি সেই উত্তরের প্রথম অংশটি, অর্থাৎ ‘হ্যাঁ’ ঘচাৎ করে কেটে দিলেন। মানে, তাঁর বিবেচনা হল, “পাখি কি খায়?” এই প্রশ্নের জবাব হল “পাখি দানা খায়”। এই বিচার দেখে তো বাবা-মায়ের চক্ষু চড়কগাছ – ছেলে তো কিছু ভুল লেখেনি! তাঁরা বরাবর জেনে এসেছেন ‘কি’ শব্দের প্রয়োগ হলে তার উত্তর হয় হ্যাঁ বা না-বাচক, বিপরীতপক্ষে ‘কী’ শব্দ প্রয়োগ হলে তার উত্তর হয় বস্তুবাচক। অর্থাৎ, ব্যাপারটা এমন দাঁড়ায়, “পাখি কী খায়?” এর উত্তর ‘”পাখি দানা খায়”, কিন্তু “পাখি কি খায়?” এর উত্তর হ্যাঁ বা না, ‘সহজপাঠ’ মেনে উত্তর দিলে তার জবাব “হ্যাঁ। পাখি দানা খায়”। এমনকি দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তরে পরের বাক্য না লিখলেও তা ব্যাকরণমতে সঠিক। অথচ বাংলা দিদিমণি কেটে দিয়েছেন তার প্রথম অংশ, যার মানে দাঁড়ায় তিনি দ্বিতীয় বাক্যটাই উত্তর হিসেবে চাইছেন – কিন্তু সেক্ষেত্রে যে প্রশ্নে ‘কী’ ব্যবহার করতে হয়!  

    বাবা-মা ছুটলেন স্কুলের হেড দিদিমণির কাছে, যাঁর পোশাকি নাম প্রিন্সিপ্যাল। আপাতভাবে তিনি বাংলা দিদিমণির কোনও ভুল খুঁজে পেলেন না। কিন্তু বাবা-মা বিষয়টা নিয়ে বলতে গেলে একটু চাপাচাপিই করলেন ও তাঁকে বললেন, ১৯৩৫ সালে রবীন্দ্রনাথের অধিনায়কত্বে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় যে বানান সংস্কার কমিটি তৈরি করেছিলেন, তাঁদের প্রকাশিত প্রতিবেদনে এই রীতির সমর্থন ছিল এবং তারপর থেকে এটাই স্বীকৃত বানানবিধি আর রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং তাঁর ‘সহজপাঠ’-এ এই নিয়ম অনুসরণ করেছেন। এমনকি কিছু কিছু পাঠে এই তফাত বুঝিয়েও দিয়েছেন পড়ুয়াদের জন্য। এমন তেএঁটে অভিভাবক দেখে প্রিন্সিপ্যাল কিছুটা বিপদে পড়লেন এবং জানিয়ে দিলেন বিষয়টি স্কুলের পরিচালক কমিটির কাছে পেশ করা হবে, যার সভাপতি উত্তর কলকাতার একটি নামি কলেজের বাংলা বিভাগের তৎকালীন বিভাগীয় প্রধান। অল্পদিন বাদে স্কুলসূত্রে জানা গেল, পরিচালক কমিটিতে বিশদ আলোচনা করেও বাংলা দিদিমণির মূল্যায়নে কোনও ত্রুটি তাঁরা খুঁজে পাননি। কলেজের বিভাগীয় প্রধান তথা বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে ডক্টরেট ডিগ্রিপ্রাপ্ত কমিটির প্রধান ‘কি’ ও ‘কী’ র মধ্যে কোনও অর্থগত প্রভেদ মেনে নিতে রাজি নন। অগত্যা....  

    হয়তো “ধরণী দ্বিধা হও” বলতে পারলে তৃপ্ত হতাম। কিন্তু সেটা না চেয়ে যে ভালোই করেছি তা বুঝতে পারলাম এর কয়েকবছর পরে রাজ্যের কোনও একটি জেলার সরকারি দফতর থেকে প্রকাশিত একটি সংকলন হাতে পেয়ে। সেখানে দফতরের ভারপ্রাপ্ত মন্ত্রী, সচিব, অতিরিক্ত জেলাশাসক প্রমুখ প্রত্যেকে সংকলন-প্রয়াসকে শুভেচ্ছাবার্তা দিয়েছেন এমন ভাষায় যেখানে বাংলাভাষার ন্যূনতম ণত্ব-ষত্ব জ্ঞানের আদ্যশ্রাদ্ধ ঘটানো হয়েছে। বলতে পারা যায়, তখন থেকেই এই বিষণ্ণ সিদ্ধান্তের দিকে ঢলে পড়েছি যে, এই বঙ্গদেশে অধ্যাপনা, শিক্ষকতা, আমলাগিরি বা মন্ত্রিত্ব করতে গেলে আর যাই হোক বাংলা ভাষাটা তেমন না-জানলেও চলে যায়। আমরা যাঁদের সমাজের শাঁসালো স্তর বা ‘ক্রিমি লেয়ার’ বলে থাকি তাঁরাই যদি এমন বেপরোয়াভাবে অবুঝ ও অবাধ্য হন তাহলে গোড়া থেকে যারা বাংলা ভাষা শিখতে শুরু করেছেন তাদেরকে এই বিষয়ে সচেতন ও সজাগ থাকার পাঠ দেওয়া একরকম বেয়াকুফি বই কি! 

    তাহলে কি বাংলা বানান নিয়ে সচেতনতা আর অভিনিবেশের দায় কেবল কলমজীবী লেখক বা সম্পাদকদের, যাঁদের বাংলাভাষা ব্যবহার করে হাঁড়ি চড়াতে হয়? এই প্রশ্নের সহজ উত্তর পাওয়া খুব কঠিন। কারণ, ইতিমধ্যেই এক বিশেষ শ্রেণির মধ্যে এমন এক অনুভব যে, ভাষা হিসেবে বাংলাটা শেখা বড়ো খটোমটো, তার ব্যাকরণ বড়ো প্যাঁচালো, তার যুক্তাক্ষর এক মস্ত বিড়ম্বনা ইত্যাদি ইত্যাদি। এখন কথাটা হল, ভাষাতত্ত্বের বুনিয়াদি নিয়ম মানলে প্রতিটি ভাষাই তো তার নিজের অবস্থানে স্বতন্ত্র, কারণ প্রতিটি ভাষাই কোনো না কোনো ভাষা পরিবারের সঙ্গে অন্বিত – সেগুলিকে কেউ বা কারা বিড়ম্বনা ভাবলেই মুশকিল। বিদেশি ভাষা হিসেবে ইংরিজি বা ফরাসি বা জার্মান ভাষারও আছে নানান জটিলতার বুনন কিন্তু সেগুলি তাদের চারিত্র্য যার ওপর অভিমান করা চলে না। সেই নিয়মের বলেই তো ইংরিজিতে ‘পুত্র’ বোঝাতে ব্যবহার হয় ‘son’ , আর ‘সূর্য’-র ইংরিজি হিসেবে ব্যবহার হয় ‘sun’ – যদিও উচ্চারণগত দুটি শব্দই অভিন্ন – পরন্তু ইংরিজিতে ‘sun’ শব্দটির আগে ‘the’ শব্দটি বসানো বাধ্যতামূলক যা শুধুই একটা ভাষার নিয়ম, যে নিয়মের পেছনে রয়েছে সেই ভাষার ব্যাকরণগত বিধি। সেই একইরকম ব্যাকরণের বৈধতা মেনেই কিন্তু ‘কি’ আর ‘কী’র আলাদা ব্যবহারের কথা ভাবা হয়! 

    কিন্তু কথা হল, ইংরিজি বানানের প্রশ্নে আমরা যতটা সজাগ ও ইংরিজি বানানের ভুল প্রয়োগের সঙ্গে নিজেদের আত্মসম্মানকে যেভাবে জড়িয়ে নিয়েছি, তার সিকি ছটাকও আমরা বরাদ্দ করিনি বাংলা বানানের জন্য। ইংরিজির সঠিক বানান শেখার জন্য স্কুলের নিম্নতম স্তর থেকে আমাদের বারবার পরীক্ষা দিতে হয়, বাংলা বানানের জন্য তেমন ঝক্কি পোহাতে হয় না। ‘ভালো’ ইংরিজি শেখার জন্য বুনিয়াদি স্তর থেকে বাড়তি শিক্ষক লাগে, কিন্তু আমরা ধরেই নিই – বাংলাটা যে কেউ পড়িয়ে দিতে পারেন। বিদেশি ভাষা হিসেবে প্রথম প্রজন্মের পড়ুয়াদের কীভাবে ইংরিজি শেখানো ও সড়গড় করা যায় তা নিয়ে প্রভূত চিন্তা-ভাবনা করা হয়, বছর দশ-বারো আগে ব্রিটিশ কাউন্সিলের সঙ্গে জুটি বেঁধে এসব নিয়ে স্কুলের মাস্টারমশাইদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছিল বলেও আমরা শুনেছি – ভালোই হয়েছিল। কিন্তু পাশাপাশি মুখের ভাষা থেকে চর্চার ও ব্যবহারের ভাষা হিসেবে কীভাবে বাংলাকে শেখানো যায় সেইটাও একটা চিন্তা ও অনুশীলনের উপাদান – এই বোধ কি ক্ষণিকের জন্য হলেও আমাদের অবচেতনে হানা দিয়ে গেছে? নাকি বাংলাটা মাতৃভাষা তাই এইসব উদ্ভট চিন্তাকে প্রশ্রয় দেওয়াটাই একরকম বাতুলতা! তাই হয়তো বাংলা মাধ্যম স্কুলগুলি পড়ুয়ার অভাবে ধুঁকতে ধুঁকতে উঠে যায়, তাদের কোনো কোনোটিকে আবার ইংরিজি মাধ্যমের কোরামিন দিয়ে বাঁচিয়ে রাখবার চেষ্টা হয় ঘুরপথে। যেহেতু বাংলা আমাদের মাতৃভাষা, তাই বাংলা বানানে যা খুশি স্বেচ্ছাচার করে দেওয়াল লেখা যায়। ছাপানো যায় পোস্টার-ব্যানার-ফ্লেক্স – যেমন খুশি তেমন!

    অভিভাবকহীন দুয়োরানি বাংলাভাষার জন্য ওপার থেকে ধার করে একটা দিন আমরা কাঁদুনি গাওয়ার ফুরসত পাই, সেই তো ঢের। যে ভাষাকে আমরা ভালোবাসি না সেই ভাষাও এক নীরব অভিমানে দূরে সরে যায় আমাদের থেকে। এর পরে আর ক-য়ে ‘ই’ বা ক-য়ে ‘ঈ’ এর তফাত কেউ মানলেন বা ভাঙলেন তাতে আমাদের কী-ই বা যায় আসে?  
     

    বঙ্গদর্শনের সপ্তাহের বাছাই করা ফিচার আপনার ইনবক্সে পেতে

    @