No Image

   

00:00
00:00
Volume

 0 Songs

    সৃজনচর্চার মিলনমঞ্চ বাংলাদেশের ‘ছায়ানট’

    সৃজনচর্চার মিলনমঞ্চ বাংলাদেশের ‘ছায়ানট’

    Story image

    ১৯৬১ সালে রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী পালন করবার ইচ্ছা নিয়ে পাকিস্তানি শাসনের থমথমে পরিবেশেও কিছু বাঙালি জোটবাঁধলেন। সারা বিশ্বে শতবার্ষিকীর আয়োজন চাঞ্চল্য জাগিয়েছিল বাংলার সেই প্রান্তের সংস্কৃতিসচেতন মানুষের মনে। বিচারপতি মাহবুব মুর্শেদ, ডঃ গোবিন্দচন্দ্র দেব, অধ্যাপক মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী প্রমুখেরা যেমন উদ্যোগী হলেন - তেমনি ঢাকার কিছু সংস্কৃতিকর্মীও যুক্ত হলেন শতবর্ষ উদযাপনে। অগ্রাহ্য হল সমস্ত নিষেধ। শতবার্ষিকী উদযাপন করার পর এক বনভোজনে গিয়ে সুফিয়া কামাল, মোখলেসুর রহমান (সিধু ভাই), সায়েরা আহমদ, শামসুন্নাহার রহমান (রোজ বু), আহমেদুর রহমান (ইত্তেফাকের ‘ভীমরুল’), ওয়াহিদুল হক, সাইদুল হাসান, ফরিদা হাসান, সনজীদা খাতুন, মীজানুর রহমান (ছানা), সাইফউদ্দীন আহমেদ মানিকসহ বহু অনুপ্রাণিত কর্মী সাংস্কৃতিক আন্দোলন চালিয়ে যাবার জন্যে সমিতি গঠন করার সিদ্ধান্ত নেন। জন্ম হয় ছায়ানটের। হাড়হিম করা পাকিস্তানি যুগের শাসনে মুক্ত রবীন্দ্রচর্চা ভাবনায় যাত্রা শুরু করে ছায়ানট। 

    মূলত সঙ্গীতকে প্রাধান্য দেওয়াই ছায়ানটের মূল উদ্দেশ্য। সঙ্গীতে শিক্ষাগ্রহণ করার জন্য স্ব-স্ব ক্ষেত্রে কীর্তিমান গুণী শিল্পীরা ভিড় করেন ছায়ানটে। ধীরে ধীরে চিন্তাবিদ, শিক্ষাবিদ, সাহিত্যিক, চিত্রশিল্পী, নাট্যশিল্পী, চলচ্চিত্র সংসদ-কর্মী, বিজ্ঞানী, সমাজব্রতী ইত্যাদি নানা ক্ষেত্রের সচেতন মানুষের সৃজনচর্চার মিলনমঞ্চ হয়ে ওঠে ছায়ানট। সৃজনের মধ্য দিয়েই পরিচালিত হয়েছিল ছায়ানটের প্রতিরোধী ও সর্বব্যাপী সংস্কৃতি-সাধনা। বাংলা নববষের্র প্রভাতী সঙ্গীতায়োজনের সুবাদে ছায়ানট বাঙালিত্বকে আবার প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছে স্বভূমিতে, স্বদেশের মুক্তি আন্দোলনে যা হয়ে উঠেছে প্রেরণাদায়ক।

    স্বাধীনতা-পরবর্তীকালে ছায়ানট বাঙালির সার্বিক সংস্কৃতি চেতনাকে আরো ব্যাপকভাবে ধারণ করার তাগিদ থেকে উদ্যোগ নিয়েছে সংগঠনের নানাবিধ কর্মধারা। মূলত দায় এবং দায়িত্ব থেকেই ছায়ানট দুর্যোগ দুর্বিপাকে মানুষের পাশে দাঁড়ায়। ষাটের দশকের আরম্ভে দেশের দক্ষিণোপকূলে গোর্কি আঘাত হানার পর কোনো সরকারি সাহায্য ছাড়া উপদ্রুত এলাকায় ত্রাণ নিয়ে গিয়েছিল ছায়ানট। গান গেয়ে মিছিল করে পথচারী, রিকশাচালক, এমনকি ভিখারিদের কাছ থেকেও পাঁচ-দশ টাকা নিয়ে জমিয়েছিল পঞ্চাশ হাজার টাকা। সে সংগ্রহের অনেকাংশ দুর্যোগকালের আশ্রয়স্থল আর দুটি বিদ্যালয় ভবন উন্নয়নের জন্য দেওয়া হয়। পরবর্তীকালেও তাঁরা থেমে থাকেননি। 

    স্বাধীনতার আগে বাংলা একাডেমি, ইংলিশ প্রিপারেটরি স্কুল (বর্তমান উদয়ন বিদ্যালয়ের পুরনো ভবন), আজিমপুর কিণ্ডারগার্টেন (বর্তমান অগ্রণী বালিকা বিদ্যালয়) এবং কলাবাগানের লেক সার্কাস হাইস্কুলে স্থানান্তরিত হয়ে কাজ চালিয়ে এসেছে ছায়ানট। স্বাধীনতার পর তিন দশকের জন্য ঠাঁই পায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ল্যাবরেটরি স্কুল ভবনে। সাংস্কৃতিক প্রতিরোধ থেকে স্বাধীনতার যুদ্ধ পর্যন্ত বাঙালির গৌরবের অংশীদার। স্বাধীনতার পর সংস্কৃতি ও সঙ্গীতচর্চাকে আরো ব্যাপক ও নিবিড় করে তোলার সৃষ্টিশীল সাধনায় নিমগ্ন রয়েছে এ-প্রতিষ্ঠান। পাঁচ দশক ধরে ছায়ানট বাঙালি সংস্কৃতির নবজাগরণের লক্ষ্যে গান, নৃত্য, যন্ত্রসঙ্গীত প্রশিক্ষণ ও প্রসারে নিয়োজিত। সাংস্কৃতিক সাক্ষরতা ও সংস্কৃতি বিকাশের লক্ষ্যে ছায়ানট বিভিন্ন কার্যক্রম গ্রহণ করেছে। আছে সঙ্গীতবিদ্যায়তন, সংস্কৃতি সমন্বিত সাধারণ শিক্ষার বিদ্যালয় ‘নালন্দা’, শিশুদের মনন বিকাশের কার্যক্রম ‘শিকড়’, অটিস্টিক শিশুদের স্বাভাবিক বিকাশের সহায়ক কার্যক্রম ‘সুরের জাদু-রঙের জাদু’, উপমহাদেশ এবং বিশ্বের ক্লাসিক সাহিত্য ও পরবর্তী মহান সৃষ্টিসমূহ এবং সমাজ-সংস্কৃতি-মানবতা নিয়ে আলোচনার কার্যক্রম ‘ভাষা-সংস্কৃতির আলাপ’, নিয়মিত গানের অনুষ্ঠান ‘শ্রোতার আসর’। ভাষা ও সঙ্গীত, সাহিত্য, নাটক, চলচ্চিত্র, চারুশিল্প, নৃত্যসহ শিল্পকলার যাবতীয় ক্ষেত্রে ছায়ানটের কর্মোদ্যম প্রসারিত হয়ে চলেছে।

    বাংলা সংস্কৃতির বুকে গর্বের সঙ্গে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে ছায়ানট। সাংস্কৃতিক দিক ছাড়াও রয়েছে পত্রিকা ‘বাংলাদেশের হৃদয় হতে’ এবং প্রকাশনা। যে শাসনকে তুচ্ছ করে একদিন জয় হয়েছিল বাংলার, যে ভাবনা থেকে সাংস্কৃতিক স্রোতে গা ভাসিয়েছিলেন একদল মানুষ, তাঁদের সেই স্বপ্ন ক্রমশ দৌড়ে চলেছে। পাণ্ডিত্য এবং মেধার সমন্বয়ে ছায়ানট হয়ে উঠুক আপামর বাঙালির সৃজনচর্চার মিলনমঞ্চ।

    বঙ্গদর্শনের সপ্তাহের বাছাই করা ফিচার আপনার ইনবক্সে পেতে

    @