No Image

   

00:00
00:00
Volume

 0 Songs

    নজরুলের জীবনে বুলবুল

    নজরুলের জীবনে বুলবুল

    Story image

    নজরুলের জীবন ছিল বড় অদ্ভুত। অভাবে, অনটনে, দুঃখে, শোকে তিনি যখন পাথর, তখনও সৃষ্টি করে চলেছেন হাস্যরস। প্রিয়পুত্র বুলবুলের অকালমৃত্যু কবির হৃদয় বিদীর্ণ করেছে তবুও এইসময় তিনি লিখলেন ‘চন্দ্রবিন্দু’র মতো কাব্যগ্রন্থ।

    নজরুল-গবেষক বলেন, কৃষ্ণনগরে নজরুল যখন থাকতেন তখনই অনবদ্য সব সঙ্গীত সৃষ্টি করেছিলেন। ১৯২৭ সালের ১৩ মার্চ তাঁর দ্বিতীয় পুত্র বুলবুলের অন্নপ্রাশন হয়েছিল কৃষ্ণনগরে। এরপর তিনি চলে আসেন কলকাতায়। নলিনীকান্ত সরকারের ১৫ নম্বর জেলিয়া টোলা স্ট্রীটে আশ্রয় নিয়েছিলেন। এখানে নানা অসুবিধা তৈরি হওয়ায় তিনি চলে আসেন এন্টালিতে। ৮/১ পালবাগান লেনের এক বাড়িতে। এখানে কবির তৃতীয় পুত্র কাজী সব্যসাচীর জন্ম হয়।

    ১৯৩০ সালের ৭ মে তাঁর প্রাণাধিক প্রিয় পুত্র বুলবুলের মৃত্যু হয় বসন্ত রোগে। ছেলের ভাল নাম তিনি রেখেছিলেন অরিন্দম খালেদ। ছেলে বসন্তে আক্রান্ত হওয়ায় নজরুল ডাক্তার, কবিরাজ, বদ্যি সবকিছু করেও ছেলেকে সুস্থ করে তুলতে পারেননি। কারও কাছে শুনেছিলেন, দমদমের কাছে এক সাধু থাকেন। তিনি বসন্ত রোগে আক্রান্ত রোগীদের সুস্থ করে তুলছেন। কবি তাঁর বিশ্বস্ত দুই সঙ্গী মৈনুদ্দিন আর শান্তিপদ সিংহকে পাঠালেন সাধু আনার জন্য। সাধুকে নিয়ে যখন তাঁরা এলেন তখন বেশ রাত হয়েছে। মৈনুদ্দিন তাঁর 'যুগ স্রষ্টা নজরুল' গ্রন্থে লিখছেন, ‘কবির বাড়িতে যখন সাধুকে নিয়ে এলাম, তখন বেশ রাত হয়েছে। আমাদের সাড়া পেয়ে কবি ছুটে এলেন। বুকে জড়িয়ে কাঁদতে লাগলেন। বললেন, ওরে মৈনুদ্দিন, সাধু কি মরদেহে প্রাণ ফিরিয়ে আনতে পারে? কবি আমার কাঁধ বারবার ঝাঁকাতে লাগলেন। আর একই কথা বারবার বলতে লাগলেন।' তার ঠিক দশ মিনিট আগে বুলবুলের মৃত্যু হয়েছিল।

    বুলবুলের মৃত্যু কবির জীবনযাত্রা পাল্টে দিয়েছিল। তিনি সমস্ত উচ্ছ্বাস বর্জন করে ছিলেন। নতুবা নজরুল ছিলেন এক প্রাণচঞ্চল মানুষ। দুঃখ, কষ্টেও তিনি ছিলেন প্রাণশক্তির এক অনন্য উদাহরণ, কিন্তু বুলবুলের মৃত্যুর পর গভীর রহস্যের সামনে দাঁড়িয়ে পরম সত্যকে ধরে বাঁচতে চাইছিলেন। এরপর তিনি ঝুঁকে পড়লেন আধ্যাত্ম্য সাধনার দিকে। পরম শান্তি খোঁজার চেষ্টা চালাচ্ছেন তিনি। কবি জসীমুদ্দিন লিখছেন, তিন একদিন নজরুলকে খুঁজে পেলেন ডিএম লাইব্রেরির এককোণে। পুত্রশোক ভোলার জন্য তিনি তখন হাসির কবিতা লিখছেন। আর কেঁদে চলেছেন। চোখ দুটো জবা ফুলের মতো লাল করে ফেলেছেন।

    বুলবুল যখন শেষশয্যায় তখন তিনি ছেলের মাথার কাছ থেকে উঠতেন না। সেখানে বসে তিনি অনুবাদ করলেন 'রুবাইয়াৎ ই হাফিজ'। জুলাই তা প্রকাশিত হয়। বুলবুল-কে তা উৎসর্গ করলেন তিনি। প্রিয়তম পুত্রের মৃত্যুর পর তিনি  কার্যত উন্মাদ হয়ে গিয়েছিলেন। উৎসর্গ পত্রে তাই তিনি লিখলেন, 'তোমার মৃত্যু শিয়রে বসে "বুলবুল ই সিরাজ" হাফিজের রুবাইয়াতের অনুবাদ আরম্ভ করি। যেদিন অনুবাদ শেষ করে উঠলাম, সেদিন তুমি আমার কাননের বুলবুলি - উড়ে গেছ। যে দেশে গেছ সে কি বুলবুলিস্তান, ইরানের চেয়েও সুন্দর? জানি না তুমি কোথায়? যে লোকেই থাক, তোমার শোক-সন্তপ্ত পিতার এই শেষদান শেষ চুম্বন বলে গ্রহণ ক'রো।"

    বুলবুলের মৃত্যুর খবর জানানো হল নলিনী সরকারকে। পুত্রহারা নজরুল সম্পর্কে তিনি লিখছেন, আমাকে দেখে অতবড় দুর্দম বিদ্রোহী নজরুল 'আমার বুলবুল উড়ে গেছে নলিনীদা' বলে আমার সামনে আছড়ে পড়ল।' মুজাফ্ফর আহমেদ লিখলেন, 'একটি ক্ষুদে যাদুকর ছিল সে ( বুলবুল)। নজরুলের বন্ধুদের সঙ্গে সে চলে যেত। ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটিয়ে আবার নিজের বাড়িতে ফিরে আসত। অদ্ভুত ছিল তার স্মৃতিশক্তি। অসুখের সময় বুলবুল তার বাবাকে কখনও কাছ ছাড়া হতে দেয়নি। তার চোখের মধ্যে বসন্ত হয়েছিল। বেঁচে থাকলে সে অন্ধ হয়ে যেত। নজরুল একদিন আমায় বলেছিলেন, উস্তাদ জমিরুদ্দিন সাহেবের সঙ্গে যখন সঙ্গীত নিয়ে আলোচনা হত, তখন বুলবুল শুনে-শুনে সব আয়ত্ত করত। বড় হলে সে গায়ক হত বা নামী সঙ্গীতজ্ঞ।’

    কলকাতায় ১৩টি জায়গায় ছিলেন নজরুল। তালতলায় যখন ছিলেন, তখন লিখেছিলেন ‘বিদ্রোহী’ কবিতা। আজও তালতলায় বড় অনুষ্ঠান হয় সেই স্মৃতিতে। সরকার ১৩টি জায়গাতেই স্মৃতিফলক বসিয়েছে। নজরুল তীর্থে চলছে গবেষণার কাজ।

    বঙ্গদর্শনের সপ্তাহের বাছাই করা ফিচার আপনার ইনবক্সে পেতে

    @