প্রথম বাঙালি স্থপতি, রবীন্দ্রনাথ আর বসুবাটির গল্প

শ্যামবাজারের পাঁচমাথা ছাড়িয়ে কয়েক পা। তারপরেই বাঁহাতে সোজা চলে গেছে বাগবাজার স্ট্রিট। এই স্ট্রিট বরাবর হাঁটতে হাঁটতে একপাশে ঢুকলেই গঙ্গা। গঙ্গায় যাওয়ার পথ যেমন, তেমন এই রাস্তাই নিয়ে যেতে পারে গিরিশ ঘোষের বাড়িতেও। যাকে মাঝখানে রেখে দুপাশ দিয়ে হুস হুস করে বেরিয়ে যাচ্ছে মোটরগাড়ি। এই রাস্তার কাছেই পড়বে ভগিনী নিবেদিতার বাসস্থান। পড়বে সারদাদেবীর বাড়ি। আর এই রাস্তাতেই পড়বে বসুবাটি। পুরাকালের ধ্বংসাবশেষের মতো দাঁড়িয়ে রাস্তার সীমানা নির্দেশ করছে।
বাগবাজার স্ট্রিটের নকশা আগে ছিল অন্যরকম। তখন অবশ্য এই বসুবাটি রাস্তা জুড়েই থাকত। এখন সরতে সরতে সে কোণে ঠেসে গেছে। যাইহোক, বাগবাজার স্ট্রিটে পৌঁছে ডানদিকে চোখ রাখলেই পথ নির্দেশিকা চোখে পড়বে। বাগবাজার মাল্টিপারপাস স্কুল ছাড়িয়ে ডানহাতে। একদিকে হোটেলের বিজ্ঞাপন। পাশেই এই হোর্ডিং। হোর্ডিং বরাবর সোজা ঢুকে এলেই রাস্তা আটকে দাঁড়াবে বসুবাটি।
রাস্তা না বলে গলি বলাই ভালো। কানাগলি। নির্জন দুপুরে এই গলিপথ ধরে বিশাল বাড়িটির সামনে এসে দাঁড়ালে গায়ে কাঁটা দেবেই। প্রথম সমস্যা যেটা হবে, তা হল বাড়িটির চৌহদ্দি ঠিক ঠাহর করা যাবে না। গাছগাছালি দিয়ে, লোহার গেট দিয়ে এমনভাবে আটকে রাখা, যে দেখলে মনে হয়, বড়ো বাড় বেড়েছিল বলে বেঁধে রাখা হয়েছে। সত্যিই বড়ো বাড়। বাইশ বিঘে জায়গার ওপর তৈরি হওয়া, হাত-পা মেলা সুবিশাল এই বাড়ি। একেবারে মারাঠা ডিচ লেন পর্যন্ত পৌঁছে গেছে সে। কিন্তু কোথায় সেই বাইশ বিঘে? বাড়িটির সামনের অংশটাই চোখে পড়ে শুধু। পিছনের অংশে পৌঁছানো তো দূরের কথা, ভিতরেই ঢোকা যায় না। গেট দিয়ে আটকানো। অগত্যা সামনের ছোটো পরিসরে দাঁড়িয়ে কল্পনা করে যাওয়া ছাড়া অন্য উপায় নেই। চারধারে থোকায় থোকায় ফুলের গাছ। বাড়িটির দেওয়াল ফুঁড়ে গাছের শিকড়। পুরোনো বাড়িতে পায়রারা আস্তানা নেবেই। তবে এখানে তা খুব বেশি দেখা গেল না। অল্প কয়েকটাই ওড়াউড়ি করছিল বকম বকম শব্দে। আর এরই মাঝে উঁচু বিশাল থামগুলোর মাথায় মাথায় দাঁত বের করা হিংস্র সিংহ। সিংহমুখো থাম এই প্রথম চোখে পড়ল আমার। অনেক খুঁজেপেতে বের করলাম একটি ফলক। যার অনুসন্ধানেই মূলত আসা।
১৯০৫ সালের ১৬ অক্টোবরে ( ৩০ আশ্বিন, ১৩১২ বঙ্গাব্দ) বঙ্গভঙ্গের প্রতিবাদে ও বাংলার শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখার উদ্দেশ্যে রবীন্দ্রনাথের উপস্থিতিতে এই বাড়িতেই তৈরি হয়েছিল ন্যাশনাল ফান্ড। ১৯৮৬ সালে, রবীন্দ্রনাথের ১২৫তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে কলকাতা পুরসভা এই বাড়িকে তাই হেরিটেজ ঘোষণা করে। ফলকের গায়ে এই তথ্যটুকুই লেখা। যদিও সে ফলকও ক্ষয়ে অতি আবছা ও মলিন হয়ে গিয়েছে। এটুকু বাদ দিয়ে, বাড়িটি কার, কত সালের-- তার কিচ্ছুটি কোথাও লেখা নেই।
বাড়িটির নির্মাতা নন্দলাল বসু ও তার ভাই পশুপতিনাথ বসু। তাঁদের পিতা মাধবচন্দ্র বসু ছিলেন গয়ার জমিদার। কলকাতার এই বিশাল জমি ছিল তাঁর ভাইয়ের। সেই সম্পত্তি পায় মাধবচন্দ্রের জ্যেষ্ঠ পুত্র মহেন্দ্রনাথ। কিন্তু তাঁর অকাল মৃত্যুতে জমি চলে আসে নন্দ বসু ও পশুপতিনাথের জিম্মায়। বাড়ি তৈরির জন্য তাঁরা ডেকে নিয়ে আসে নীলমণি মিত্রকে। বাংলার প্রথম পাশ করা সরকারের খেতাবি ইঞ্জিনিয়ার। এই নীলমণি মিত্রর অসামান্য কীর্তিকলাপও আমরা ভুলতে বসেছি। বেলগাছিয়া স্কুল, বিদ্যাসাগর কলেজ, টেগোর ক্যাসেল ও আরো নানা কিছুর সঙ্গে জড়িয়ে আছে এঁর হাতযশ।
তবে, অনেকেই মনে করেন নীলমণি মিত্রর শ্রেষ্ঠ কীর্তি বসু বাটিই। কারণ, এখানে নাকি তিনি প্রথাগত ইউরোপীয় কাঠামোর বাইরে এসে বাংলার প্রাচীন নির্মাণরীতি ও ইসলামিক রীতির মেলবন্ধন ঘটিয়েছেন। অভিজ্ঞ ব্যক্তির চোখে নিশ্চয়ই তা একদেখাতেই নজরে পড়বে। দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায় ‘বনেদি কলকাতার ঘরবাড়ি’তে লিখছেন, “দক্ষিণামুখী বাড়িটির গঠনরীতি বিম এন্ড পিলার বিল্ডিং টাইপের। সারি সারি ষোলোটি ডরিক থাম বাড়িটির সামনের শ্রীবৃদ্ধি করেছে।... ডরিক থামের বৈচিত্র্য আনা হয়েছে মাথার দিকে বড়ো বড়ো পদ্মপাপড়ির নকশায়। পদ্মপাপড়ির নিচে প্রতিটি থাম পরিবেষ্টন করে আছে কেশরশোভিত একডজন সিংহের মাথা। সেই সঙ্গে আছে প্লাস্টারে তৈরি রুদ্রাক্ষের মালা।...”
দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায়ের বর্ণনায় বাড়িটির আরো কিছু অনুপম বৈশিষ্ট্যর সন্ধান মেলে। যেমন, দু-সারি খিলান পেরিয়ে ঠাকুরদালানে প্রবেশের নকশা, সেখানে ম্যুরাল বা দেওয়ালচিত্র। তাতে পদাতিক বাহিনী এবং রথবাহিনীর ঘোরতর যুদ্ধের ছবি। দাবার বোর্ডের মতো সাদা ও কালো মার্বলের মেঝে। আরো নানাকিছু। যা চোখ ধাঁধিয়ে দেয়। বাড়িটি তৈরির কাজ শুরু হয়েছিল ১৮৭৬-এর ১৯ অক্টোবর। শেষ হয় ১৮৭৮-এর ১৯ জুলাই। অর্থাৎ, দেড়শো বছরও পেরোয়নি বাড়িটির বয়স। আর তাতেই ভেঙেচুড়ে একাকার। এই যে এত অলঙ্কৃত দেওয়াল মেঝের গল্প, হ্যাঁ সত্যিই তা গল্প। এগুলোর কিচ্ছুটি চোখে পড়বে না। কতগুলো ক্ষয়ে যাওয়া সিংহমুখ শুধু এখনো বেশ রাগ নিয়ে তাকিয়ে আছে।
এই বাড়ি থেকেই বঙ্গভঙ্গের রাখিবন্ধন মিছিলটির যাত্রা শুরু হয়েছিল। সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জি সভা করেছিলেন। সে যুগের তিনটি ছাত্র সম্মেলন হয়েছিল এই বাড়ির অন্দরে। আজও আন্দোলনে মিছিলে ভরে থাকে যে কলকাতা, সে তার এমনি একটি আশ্রয়কে বেমালুম ভুলে গেছে। ৬৫ নম্বর বাগবাজার স্ট্রিট-- এই ঠিকানাটিও আর অক্ষুণ্ণ নেই।
দেড়শো বছর কিন্তু বাস্তবিকই এমনকিছু বেশি নয়। তারও ঢের পুরোনো মন্দির, দরগা, গির্জা বহাল তবিয়তে জীবিত আছে। জীবিত আছে বেশকিছু রাজপ্রাসাদ ও আরো অনেক স্থাপত্য। কিন্তু, বাঙালির প্রথম প্রযুক্তিবিদের এই অসাধারণ শিল্পটি কেন রইল না, তা আশ্চর্য। অথচ, দেশজুড়ে ইঞ্জিনিয়ারের ছড়াছড়ি। আর্কিটেক্টও নেহাত কম নেই। তাদের দর্শনীয় হয়ে উঠতেই পারে অসম্ভব কারুকার্যময়, শিল্পিত এই প্রাসাদটি।
আর, বঙ্গভঙ্গ বিরোধিতার তোলপাড় করা বছর ১৯০৫। তারও তো স্মৃতিমেদুর এই প্রাসাদ। বাঙালির নতুনভাবে আত্মপ্রকাশ। রাস্তায় রাস্তায় পিকেটিং, ‘মায়ের দেওয়া মোটা কাপড়...’ গান-- তার স্মৃতি মিশে আছে বাড়িটির প্রতিটি ইটে। স্বদেশি আন্দোলনে নিশ্চিত বাড়িটির বড়ো ভূমিকা ছিল। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে নিশ্চয়ই ছিল স্বদেশকে ঘিরে নানা পরিকল্পনা, কথোপকথন। সে সবকিছুই আজ ভেঙে পড়ার আশায় দাঁড়িয়ে রয়েছে।
ভগ্নাবশেষটির দেখাশোনা করেন যে ভদ্রলোক, জং ধরা গেট খুলতে খুলতে বললেন, বাড়িটি নাকি অম্বুজা কিনে নিয়েছে। সত্যিমিথ্যে জানা নেই।
যেটুকু বাকি রয়ে গেছে, কিছু মায়া রয়ে যাওয়ার মতো করে, সেটুকুকে দেখে আসা প্রয়োজন। ছুঁয়ে আসা দরকার। নাহলে কবে যে তা একেবারে গুঁড়িয়ে যাবে, একটা ইতিহাস গুঁড়িয়ে যাবে তা জানাও যাবে না।