বাংলার অন্ন-কথা

প্রথম পর্ব
ধানের নাম ‘দুই সতীন’ শুনে লোকমান মোল্লার মুখের দিকে তাকিয়ে ছিলাম অনেকক্ষণ।
গোলা থেকে মাটির কলসি ভরা ধান নিয়ে এলেন মথুরাপুরের কৃষক। একটা ধানের ভেতর দুটো হালকা লালচে সরু চাল, পাশাপাশি শুয়ে আছে। বাপ ঠাকুরদার আমল থেকে চাষ করছেন লোকমান। আগে ছ’ বিঘে জমিতে চাষ করতেন, এখন করেন তিন বিঘে। আষাঢ়ে আমন চাষের শুরুতে জমিতে হালকা কাদা করে চারাগাছ রুয়ে দিয়ে আসেন দক্ষিণ ২৪ পরগণার কৃষক। জমিতে সার দিতে হয় না,কোনো কীটনাশক লাগে না, জল লাগে না। ৫ মাস পর জমি থেকে শুধু ধান কেটে নিয়ে আসেন। এক বিঘে জমিতে ধান হয় ৯/১০ মণ।
দু সতীনের চাল খেতে পেঁজা তুলোর মত। আবার পেটে অনেকক্ষণ থাকে। লোকমান আষাঢ় মাসের আগে জমিতে একবার গোবর সার দিয়ে আসেন, আর তাতেই দু সতীনের এত ফলন। দক্ষিণ ২৪ পরগণার দুই সতীন বীরভূমে নাম হয়েছে যুগল আর বাঁকুড়ায় হয়েছে লব -কুশ।
বাঁকুড়ায় উঁচু জমিতে হয় বলে খেতে একটু আলাদা। বীরভূমে রং একটু বেশি লাল। তবে খেতে দক্ষিণের মত। লোকমানের গোলায় তিন সতীন ধানের বীজ রয়েছে দু কলসি। তাঁর বাবা যখন বেঁচে ছিলেন তখন তিন সতীনের চাষ করতেন। ফলন ছিল দু সতীনের চেয়ে সামান্য বেশি। এখন আবহাওয়ার তিন সতীনের ফলন কম। এক বিঘেতে এখন ধান হয় ৭/৮ মণ। পুরনো ধানের বীজ এখনও রাখবেন বলেই ৬ কাঠা জমিতে চাষ করেন লোকমান। বাপ-ঠাকুরদার রেখে যাওয়া বীজ হারাতে চান না তিনি।ছোটবেলায় তিন সতীন ধানের জমিতে বিকেলে বসে থাকতেন লোকমান। একটা ধানের ভেতরে তিন চাল খেতে আসত ছোট ছোট পাখি।লোকমান ফাঁদ পেঁতে রাখতেন। সেই ফাঁদে পাখি পড়ত। তিন সতীনের জমি থেকে পাখি উড়ে গিয়ে বসত দু সতীনের জমিতে। এতে দেখা গেল দু সতীনের শিসের দু-একটা ধানে তিনটে চাল। তারপর আর পাশাপাশি জমিতে কখনও চাষ করতেন না। তিন সতীনের ভাত খেতে আরও ভাল। মুখে দিলে যেন গলে যেত। পেটের অসুখ করলে মা রাঁধতেন তিন সতীনের চাল। বলতেন এ চালের ভাত খেলে পেটের অসুখ সেরে যায়। মায়ের কথা আজও মনে আছে, লোকমান ৬ কাঠা জমিতে তাই আজও চাষ করেন। বীরভূমের পাহাড়ি এলাকায় তিন সতীনের চাষ আজও হয়,নলহাটির আদিবাসী এলাকায়। লোকমানের বাড়িতে হীরামতি ধানের চাষ হত ৫ বিঘে জমিতে। তখন সবে তাঁদের বিয়ে হয়েছে। মা মাঝেমাঝে বাবাকে বলতেন, ছেলেদের বিয়ে হয়েছে, বৌমারা পোয়াতি হবে, এবার হীরামতির চাল আরও দরকার।