No Image

   

00:00
00:00
Volume

 0 Songs

    ফিরে এলেন আইয়ুব বাচ্চু

    ফিরে এলেন আইয়ুব বাচ্চু

    Story image

    বাউল সহজিয়া মতে একজন সদ্যজাতর জন্ম যদি উৎসব বলে বিবেচিত হতে পারে, তবে মৃত্যুও কেন উল্লাস হবে না? ভারতীয় প্রাচীন অঘোরী তন্ত্রমতেও এই একই বিশ্বাস রয়েছে। অতএব, সেরকমই আমাদের রুপোলি গিটারের নায়ক আইয়ুব বাচ্চুর স্মরণসভাটি হলো দুই বাংলার নবীন প্রবীণ রক আইকনদের উপস্থিতিতে এক মহোৎসব উল্লাসের মাধ্যমে গত ২৪শে নভেম্বর কলকাতার গড়িয়া সংলগ্ন পাটুলি মাঠে, যার নাম ‘দুই বাংলার রকবাজি’। আইয়ুব বাচ্চু, যিনি বাংলাদেশের রক সংগীত আন্দোলনের প্রথম শ্রেণির এক পুরোধা, গত ১৮ই অক্টোবর তাঁর মৃত্যু হয় ঢাকার স্কোয়ার হাসপাতালে। অনুষ্ঠানটির প্রধান উদ্যোক্তা ‘ক্যাফে কবীরা’, এবং অবশ্যই প্রধান উপদেষ্টা পাটুলি ১১০নং ওয়ার্ডের পৌরপিতা অরূপ চক্রবর্তী। উপস্থাপনায় দীপ শুরু থেকে শেষ, বেশ সপ্রতিভ ছিলেন।

    অনুষ্ঠান নির্দিষ্ট সময়ের চেয়ে ঘন্টাখানেক পরে শুরু হলেও, দর্শকের ধৈর্যচ্যুতি কখনোই ঘটেনি। প্রথমেই ছিল স্থানীয় ব্যান্ড ‘কাল্পনিক’। তাদের বাচ্চু ভাইয়ের স্মরণে গাওয়া “কষ্ট পেতে ভালোবাসি” ও “বানজারা-মন” বেশ সপ্রতিভ। এরপর মঞ্চ আলো করেন ‘ভূমি’ ব্যান্ড থেকে সৌমিত্র রায়। ছিলেন বিখ্যাত গান “তু লাল পাহাড়ির দেইশে যা, রাঙাহ মাটির দেইশে যা, ইতেক তুহকে মানহাইছেনাই গো” এর রচয়িতা কবি অরুণ কুমার চক্রবর্তী। তিনি ১৯৭২ সালে রচিত এই গানের ইতিহাসটি বলেন। এরপর দর্শকের কাছে বিরাট প্রাপ্তি। মঞ্চে আসেন বাচ্চুদার অনেকদিন ধরে কাজ করা ব্যান্ড ‘সৌলস’-এর ফাউন্ডার সদস্য রনিদা। এছাড়াও ছিলেন বাচ্চুদার প্রথম গিটার শিক্ষক জ্যাকব ডায়াস। নানারকম স্মৃতিচারণায় উঠে আসে অনেক অজানা তথ্য –  যেমন আইয়ুব বাচ্চু দুরন্ত ড্রাম বাজাতেন (যা তিনি কখনোই প্রকাশ্যে করেন নি), ছিলেন সুদক্ষ পার্কারশনিস্ট, অভিনয় করেছেন, টেলিভিশনের একটি অনুষ্ঠানে বছরভর হোস্ট করেছেন, ইত্যাদি। 

    স্মৃতিচারণা চলতে চলতেই উৎসব বয়ে চলে ঢেউখেলানো নদীর মতো। মঞ্চে আসেন ‘লক্ষ্মীছাড়া’ ব্যান্ডের বিখ্যাত ড্রামার সদস্য গাবু। তার গলায় বাচ্চুদার “মন চাইলে মন পাবে” এবং মহীনের ঘোড়াগুলির “টেলিফোন” (সঙ্গে দীপের খমক ও গাবুর ডুবকি) শুনে আপামর দর্শক উত্তাল হয়ে ওঠে। বাংলাদেশ থেকে আসা শিরিন এবং তারপর বাংলাদেশি পপস্টার মেহরিন মাতিয়ে দেন। মেহরিনের গলায় সেই “তুমি এবং আমি নারী” এককথায় ভাষাহীন। এরপর আরো চমক – আসেন ‘মহীনের ঘোড়াগুলি’র শুরুর সদস্য তাপস দাস এবং প্রদীপ চৌধুরী (বুলাদা)। বুলাদা নির্মাণ করেন শব্দ দিয়ে একটি সাউন্ডস্কেপ, যা কোনো তথাকথিত গান নয়, কিন্তু যে কোনো মিউজিকই তো একেকটি গান। শোনা যায়, বাচ্চুদা একসময় এধরনের কাজ রেকর্ডিং করতে উৎসাহী ছিলেন, কিন্তু কোনো পৃষ্ঠপোষক রেকর্ড কম্পানি এগিয়ে না আসায়, নিজের প্রিয় পাঁচটি গিটার বিক্রি করার সিদ্ধান্ত নেন।

    সন্ধে যতো বাড়তে থাকে, মঞ্চ হতে থাকে আরো  সংগীত উষ্ণ ঝরনা। শিলাজিৎ গেয়ে যান “বুকে আমার বারুদের বাসা সজনী” এবং “সর্বনাশ”। ‘ক্যাকটাস’ ব্যান্ডের লিড সিংগার সিধু গেয়ে যান “ফেরারি মন” এবং “নষ্ট নারী”। তারপর ‘সহজিয়া’ ব্যান্ডের দীপ। মাঝে আসেন তথ্য ও সংস্কৃতি মন্ত্রী ইন্দ্রনীল সেন। মন্ত্রী ইন্দ্রনীল কিছু সময়ের জন্য জনতার দাবিতে ফিরে যান গায়ক ইন্দ্রনীলের ভূমিকায়, গেয়ে ফেলেন ‘বিজনের চায়ের দোকান’ থেকে কয়েক কলি। এরপর মঞ্চে আসেন আর এক নবীন রক গায়ক পটা। সব নবীন প্রবীন গায়ক ও শ্রোতাদের নিয়ে গেয়ে ফেলেন “সেই তুমি”। একসঙ্গে গান বাংলাদেশের বিখ্যাত ব্যান্ড ‘ফিডব্যাক’ থেকে আগত মাকসুদদা (ম্যাকদা)।

    এরপর কিছুটা সময় কাটে পাওয়ার মেটাল –  ‘আর্টসেল’ ব্যান্ড থেকে আসা লিঙ্কন মাতিয়ে দেন গোটা মাঠ। এরপর একেএকে ‘শহর’ ব্যান্ডের প্রধান গায়ক অনিন্দ্য এবং ‘ফিডব্যাক’ থেকে ম্যাকদা। শোকসভার কোনো সুদীর্ঘ নীরবতা নয়, সংগীতের মনোমুগ্ধকর উল্লাসে আবর্তিত এক উৎসবের ভিতর দিয়ে পালিত হল এই স্মরণসভা। মানুষের কার্নিভাল দিয়ে শ্রদ্ধার এই প্রতিফলন, উজ্জ্বল হয়ে ওঠে গোটা সময়। অনুষ্ঠান শেষে বাচ্চুদার গিটার শিক্ষক জ্যাকব ডায়াসের সাথে ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় পাই আরো কিছু তথ্য। যেমন, আইয়ুবের গোঁড়া মুসলিম পরিবার কখনো চায় নি তার খ্রিস্টান শিক্ষকের কাছে গিয়ে গিটার শেখেন। তাঁর আব্বুর চূড়ান্ত প্রতিবন্ধকতাও পেরিয়ে গেছেন আইয়ুব, তাঁর নিজস্ব বিশ্বাস সঙ্গী করে। ঈশ্বর প্রদত্ত জাদু আইয়ুবের হাতে থাকলেও, তিনি কিন্তু কখনও তাঁর রেওয়াজে কোনো খামতি রাখেন নি। বরং তিনি চেয়েছিলেন সত্যিকারের এক রুপোলি গিটার যেন সকলে গড়তে পারে। মাতৃভক্ত এই উদার মনের মানুষটি বাংলা রক সংগীতের পৃথিবীতে চিরকালীন এক অনিষ্প্রভ নক্ষত্র হয়ে থাকবেন। অন্তত আপামর শ্রোতাদের দোয়া-তে তো বটেই।

    বঙ্গদর্শনের সপ্তাহের বাছাই করা ফিচার আপনার ইনবক্সে পেতে

    @