অশোক মিত্র : সুভদ্র বিদ্বান বিদ্রোহী

ক্রমশ তাঁর কানে শোনা চোখে দেখার ক্ষমতা কমে আসছে, খাদ্য গ্রহণে পাকযন্ত্র আপত্তি তুলছে। সেই সময় তিনি একটি বাংলা পাক্ষিক পত্রিকা প্রকাশ করার সিদ্ধান্ত নিলেন। ‘আরেক রকম’-এর স্থায়ী ঠিকানা তাঁর আলিপুর পার্ক রোডের বাড়ি। কিছু শুভানুধ্যায়ীর চাঁদায় প্রায় বিজ্ঞাপনহীন পত্রিকাটি মৃত্যুর সঙ্গে লড়তে লড়তেই তিনি পাঁচ বছর চালিয়ে গেলেন।
মানুষটির নাম অশোক মিত্র। এই বঙ্গে তিনি প্রথম বামফ্রন্ট সরকারের অর্থমন্ত্রী বলেই সমধিক পরিচিত। কিন্তু সেটাই তাঁর একমাত্র পরিচয় নয়। বহু বিচিত্র বিষয়ে তাঁর নিজস্ব মতামত ছিল। ফলে আর পাঁচজনের তুলনায় তিনি অনেক বেশি বিতর্কিত ছিলেন। কিন্তু যখন যে বিষয়েই তিনি অভিমত ব্যক্ত করে থাকুন না কেন, তাকে অর্বাচীন ঔদ্ধত্য বা অনধিকার চর্চা হিসেবে দেগে দেওয়ার সাহস কারোরই ছিল না।
তাঁর আত্মজৈবনিক ‘আপিলা-চাপিলা’ অনুসরণ করলেই বোঝা যায়, অশোক মিত্র যখন নিজেকে সাম্যচিন্তার শরিক তৈরি করার সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন, তখন ঢাকা থেকে পাকিস্তানের পতাকা হাতে তিনি কলকাতায় আসছেন ছাত্র সম্মেলনে যোগ দিতে, আবার বুদ্ধদেব বসুর সান্নিধ্যে তিনি অবগাহন করছেন কবিতার কুসুমিত ঝর্নাতেও।
অশোক মিত্রর নিজস্ব মতামত তৈরির সময়টি একই সঙ্গে বিষাদময় এবং চেতনার রঙে রঙিন হওয়ার কালপর্ব। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, পঞ্চাশের মন্বন্তর, ছেচল্লিশের দাঙ্গা আর দেশভাগের নিষ্ঠুর পদপাত সেই সময়কে সহস্র বেদনায় কণ্টকিত করছে একথা যেমন ঠিক, তেমন তাতেই তিনি নতুন ঊষার স্বর্ণদুয়ারের ঠিকানাও পেয়েছেন।
অর্থনীতিতে প্রথম নোবেল পুরস্কার প্রাপক ইয়ান টিনবার্জেনের অধীনেই তিনি পিএইচডি অর্জন করেন। লখনৌ বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনার সময়ে নিবিড় সান্নিধ্যে আসেন ধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের। স্ট্যাটিস্টিকাল ইন্সটিটিউট, আইআইএম এবং বহু বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ে ডাকসাইটে অধ্যাপক হিসেবেই তাঁর খ্যাতি।
আরও পড়ুন
প্রভাত পট্টনায়েকের মার্ক্স বি-চিন্তা
তিনি কমিউনিস্ট বলে একসময় প্রফুল্ল সেনরা তাঁকে স্ট্যাটিস্টিকাল ইন্সটিটিউটের ডিরেক্টর হতে দেননি। আবার কমিউনিস্ট বলেই মোহন কুমারমঙ্গলম এবং পি এন হাকসার-রা তাঁকে ইন্দিরা গান্ধীর অর্থনৈতিক উপদেষ্টা বানিয়েছিলেন। জ্যোতি বসু-প্রমোদ দাশগুপ্তরা তাঁকে বামফ্রন্টের অর্থমন্ত্রীও করেন। কিন্তু জয়প্রকাশ নারায়ণের আন্দোলনের সময়ে প্রফুল্ল সেনই তাঁকে কাছে টানেন। ইন্দিরা গান্ধী তাঁকে বেশিদিন মেনে নিতে পারেননি। তাঁকে জ্যোতি বসুর মন্ত্রিসভাও ছাড়তে হয়। তাতে একটা সময় প্রমাণ হয়, অশোক মিত্র অশোক মিত্রই ছিলেন। তিনি এই বঙ্গে বহুদিন পর থিতু হন সত্তরের দশকে। সেই সময়ে সব্যসাচীর মতো সমান দক্ষতায় বাংলা এবং ইংরেজি লিখছেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়-নির্মাল্য আচার্য সম্পাদিত ‘এক্ষণ’ এবং মুম্বাই থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক ‘ইকোনমিক’ এবং ‘পলিটিকাল উইকলি’তে। প্রতিষ্ঠিত সংবাদপত্রগুলি তাঁকে আমল দিতে শুরু করেছে অনেক পরে। এই সময়েই তিনি বামফ্রন্ট কাম সিপিআই(এম)-এর অনেকটা নিকটবর্তী হন। তবে বৃহত্তর বাম ঐক্যের প্রশ্নে তিনি নকশালপন্থীদেরও কাছাকাছি আসতে চেয়েছেন। সেটা সন্তোষ রাণা, অসীম চট্টোপাধ্যায় বা আজিজুল হকদের অনেক আগেই।
প্রথম বামফ্রন্ট ক্ষমতায় আসার পর তিনি হাতেকলমে কাজ করার অনেকটা সুযোগ পান। সেই ক্ষেত্রে তাঁর দুটি অবদান অনস্বীকার্য। প্রথমটি রাজ্য বাজেটের বরাদ্দের পুনর্বিন্যাস এবং দ্বিতীয়টি কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্ক নিয়ে একটি সর্বভারতীয় প্রতিবাদ মঞ্চ গড়ে তোলা। রাজ্য বাজেটের পুনর্বিন্যাসে ৫০ ভাগ বরাদ্দকে গ্রামমুখী করা হয়। পঞ্চায়েত ব্যবস্থার ভিতও তৈরি হয় সেই আর্থিক বরাদ্দের ভিত্তিতে। কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্ক নিয়ে দুটি সম্মেলন হয় যার একটি শ্রীনগর এবং অপরটি কলকাতায়।
কিন্তু অশোক মিত্র বামফ্রন্টকে নৈতিকতার প্রশ্নে যে সক্রিয়তায় দেখতে চেয়েছেন, তা তিনি পাননি। বামেদের কাছে তিনি একজন পণ্ডিত অর্থনীতিবিদ হিসেবেই রয়ে গেছেন। তাঁকে শেষ পর্যন্ত দলীয় কাঠামো থেকে দূরবর্তী হতে হয়েছে, যেমন হতে হয়েছে প্রাক্তন বিদ্যুৎমন্ত্রী শঙ্কর সেনকে।
কিন্তু এঁরা কেউই গড্ডালিকায় ভেসে পরিবর্তনপন্থী হননি। অশোক মিত্র জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত যা লিখেছেন বলেছেন তার সবটাই পরিচ্ছন্ন বামপন্থার পক্ষে। বামপন্থায় এক ছত্রখান চালচিত্র দেখতে দেখতে তাঁকে প্রয়াত হতে হল। তাতে বামপন্থীরা কতখানি বিহ্বল হয়েছেন তা জানা নেই। তবে প্রকৃত বামপন্থা একজন নির্ভরযোগ্য নির্লোভ সংবেদী অভিভাবককে হারাল।