জীবনের খোঁজে উড়ে যাচ্ছে ‘উড়নচণ্ডী’রা

“পালাচ্ছে দিনরাত্রি। পালাচ্ছে বারোমাস। কোথায় থামবে?”
প্রত্যেকে উড়নচণ্ডী। সব্বাই পালাচ্ছে। এই কোলাহল, এই সমাজ, সংস্কার- প্রত্যেকে প্রত্যেককে নিয়ে পালাচ্ছে। বন্ধু হয়ে একে অপরের হাত ধরে উড়ে যাচ্ছে তারা। কাউকে পরোয়া করা নেই। কঠিন পৃথিবীর মুখে কষাঘাত এনে পাল্টে ফেলতে চাইছে আপাত সমীকরণ। হলের সিটে বসে আমরা আসলে উড়ছিলাম। গল্প একটু একটু করে দৃশ্যকাব্য হয়ে যাচ্ছে, আমরাও উড়ছি। সেই দৃশ্যকাব্যের চার চরিত্র বিন্দি, মিনু, ছোটু, সাবিত্রী আমাদের মধ্যে উড়ে এসে জুড়ে বসছেন। হ্যাঁ, ‘উড়নচণ্ডী’ ছবিতে সবাই ছুটছে। সকলেই একটা লরিতে বসে সারা ছবি জুড়ে পালাচ্ছে। কেউ পালাচ্ছে নতুন সংসার করার জন্য, কেউ বা সংসার ভেঙে নতুন স্বপ্ন দেখার আশায়। এই ছবির মূল গল্পটি তাই নির্দিষ্ট করে বলা যাবে না, কারণ তা দেখার অনুভূতিটাই আসল।
“আমি খুঁজছি আমি খুঁজছি তোমার ঠিকানা, অলি গলি ঘুরে ক্লান্ত তবু তোমায় পাচ্ছি না”
ঋত্বিক ঘটকের ‘অযান্ত্রিক’ ছবিটির কথা মনে আছে? কীভাবে একটা গাড়ি তার ধোঁয়া উড়িয়ে চরিত্র হয়ে উঠছে, তার সরাসরি ইঙ্গিত সে ছবিতে ছিল। মানুষ আর যন্ত্রের বন্ধুত্ব সেখানে স্পষ্ট। উড়নচণ্ডীতেও একটি লরি তিন প্রজন্মের ধারক ও বাহক হয়ে উঠছে। তাদের কেঁদে হেসে ওঠার সাক্ষী থাকছে সে। এ নিছক তুলনা টানা নয়, পরিচালকের নিজস্ব ভাবনা। হিন্দিতে কয়েকবছর আগে ‘হাইওয়ে’ নির্মিত হয়েছিল। সেটাকেও একদিক থেকে ‘রোড মুভি’ হিসাবে ব্যখ্যা করা যায়। এবার বাংলায় নতুন এক তাজা ‘রোড মুভি’-র স্বাদ পাওয়া গেল পরিচালক অভিষেক সাহার ‘উড়নচণ্ডী’-তে। এই ছবির গল্প দর্শকের নিজের জীবনের সঙ্গে মিল খুঁজতে সাহায্য করে। ছবির মুখ্য চরিত্রদের শক্তিশালী অভিনয় ছবির প্রধান মেরুদণ্ড। চিত্রা সেন তাঁর নিজস্ব স্বভাবে উজ্জ্বল (কিছু কিছু জায়গায় যদিও তাঁকে চড়া লেগেছে)। দুই নতুন মুখ রাজনন্দিনী এবং অমর্ত্য এই ছবির গুরুত্বপূর্ণ অংশ। আগামীদিনের জন্য তাদের প্রতি রইল অনেক আশা। তবে এই ছবির সম্পদ সুদীপ্তা চক্রবর্তী। শরীরী ভঙ্গিমা এবং আঞ্চলিক কথনে তিনি অতুলনীয়। তাঁর অভিনয় দেখার জন্যই বারবার দেখা যায় এই ছবি। সিনেমাটোগ্রাফিতে সৌমিক হালদার অনবদ্য। পুরুলিয়ার ল্যান্ডস্কেপ অত্যন্ত দক্ষ হাতে সামলেছেন তিনি। লরি ছাড়াও আরও দুটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র খুঁজে পাওয়া যাবে- লোকেশন এবং বহুরূপী। লোকেশন যেভাবে ঘটনা পরম্পরায় এসেছে তা জীবন্ত ক্যানভাসে ধরা দিয়েছে। রাঢ় বাংলার এমন রূপ ধরা পড়েছে ক্যামেরায় যে, সেই রূপেই মজে যাবেন দর্শক। আর বহুরূপী যেন বারবার তাদের আরও বাস্তব জীবনের দিকে এগিয়ে দিচ্ছে। উড়ে যাওয়ার জার্নিকে সম্পূর্ণ করেছেন সঙ্গীত পরিচালক দেবজ্যোতি মিশ্র।
আরও পড়ুন
সিনেমার পর্দায় হাজির ‘ব্যোমকেশ সমগ্র’
“কোন দেশ ছেড়ে আমরা যাচ্ছিলাম...”
অনেকরকম সম্ভাবনার কথা বলেছেন পরিচালক। আমাদের জীবনের কথাই উঠে এসেছে কবিতার মতো করে। আসলে ব্যক্তি জীবন থেকে, এই সমাজের বাঁধাধরা ‘সিস্টেম’ থেকে আমরাও পালাতে চাই। কেউ পারি, কেউ পারি না। অনির্দেশের প্রতি একা একা যাত্রা। এক্ষেত্রে একা নয় কেউ, সবাই সবার বন্ধু। কেউ খুঁজছেন প্রেমিককে, কেউ বরের হাতে মার খাচ্ছেন, কেউ ছেলে-মেয়েদের থেকে নিজেকে আলাদা করে ফেলতে চাইছেন- এভাবে বন্ধুত্বের পথ চওড়া হচ্ছে। নতুন একটা অধ্যায়ে বেরিয়েছেন তিন প্রজন্ম। কেউ জানেন না আগামীতে কী আছে! আর জানেন না বলেই তাঁরা সফল। এই ছবি মেয়েদের ছবি। বিন্দি বলছেন, “মেয়েমানুষের নসীব হি অ্যাইসা। জিন্দেগি ভর মার খাতে রাহো।” প্রাসঙ্গিকতা এখানেই। লক্ষণীয়, যে চারটি চরিত্র এখানে দেখানো হয়েছে তারা প্রত্যেকেই নিম্ন-মধ্যবিত্ত শ্রেণির। আসামে চল্লিশ লক্ষ মানুষকে দেশ ছাড়ার হুমকি দেওয়া হয়, প্রতিদিন দলিতদের উপর অকথ্য অত্যাচারের একটা করে নমুনা দেখা যায়- আমরা ক্লান্ত, আমরা ভয় পাচ্ছি। ছবিটি দেখার পর একবারও কি এই প্রসঙ্গগুলো মাথায় আসবে না? এখানেই সফল উড়নচণ্ডী। পুরুলিয়ার বুনো গন্ধ, একটা সাজানো লরি, পুলিশের তাড়া খাওয়া, গ্রামের রংখেলা, আসব আসব প্রেম, নাড়ুর বদলে দুটো সিদ্ধ আলু, রাংতা মোড়া উৎসব, মহুয়ার গন্ধ- এভাবেই বন্য ‘উড়নচণ্ডী’রা বেঁচে থাক। বেঁচে থাকুক ছেলেবেলার বহুরূপী বন্ধু। পরিচালক অভিষেক সাহাকে ধন্যবাদ।