No Image

   

00:00
00:00
Volume

 0 Songs

    অনন্য দুটি বই-এর কথা

    অনন্য দুটি বই-এর কথা

    Story image

    ১) স্থান কাল পাত্র/ রাধাপ্রসাদ গুপ্ত (পূর্ণেন্দু পত্রী চিত্রিত)/ সুবর্ণরেখা/ প্রথম প্রকাশ ২০০০

    কথায় বলে, একা রামে রক্ষা নাই, সুগ্রীব দোসর। রাম যদি রাধাপ্রসাদ তো পূর্ণেন্দু পত্রী যেন তাঁর দোসর সুগ্রীব। তাঁর কালের অন্য অনেক পণ্ডিত মানুষের মতোই রাধাপ্রসাদ প্রায় কিছুই লেখেননি, আড্ডাপ্রিয় মানুষটি ভবঘুরের মতো জীবন কাটিয়েছেন, তাঁকে দিয়ে নিয়মিত কলাম লেখানো! মানুষটির কী বিশেষ গুণ ছিল? এমন প্রশ্নের উত্তর দেওয়া শক্ত, তবু এটুকু অবশ্যই বলা যায় যে, ‘প্রতিভা তাহার যতটা ধনী ছিল ততটা গৃহী ছিল না’ এবং অবশ্যই বলা উচিৎ যে, স্বাধীনতার পর থেকে বিশ শতকের প্রায় শেষ পর্যন্ত বাংলা শিল্প-সংস্কৃতির জগত আলো করেছিলেন চারজনঃ রাধারমণ মিত্র, সত্যজিৎ রায়, কুমারপ্রসাদ আর রাধাপ্রসাদ গুপ্ত(১৯২০-২০০০)। কলকাতায় বসে মার্ক্স ও রবীন্দ্রনাথ, বাংলার সংস্কৃতি, শিল্পকলা, সাহিত্য ইত্যাদি বিষয়ে জানতে-বুঝতে একটিবার শাঁটুলবাবুর(রাধাপ্রসাদের ডাকনাম) সাথে আড্ডা না দিলে জানা-বোঝা সম্পূর্ণ হত না। বই ও শিল্পবস্তু সংগ্রাহক রাধাপ্রসাদ কলকাতা চিনতেন হাতের তালুর মতো।

    ১৯৮০-র দশকে পূর্ণেন্দু পত্রীর ডাকে সাড়া দিয়ে রাধাপ্রসাদ ‘স্থান কাল পাত্র’ নামে একটি পাক্ষিক কলাম লেখা শুরু করলেন ‘প্রতিক্ষণ’ পত্রিকায়। তখন কলকাতা থেকে দূরে বাস করি, প্রতিক্ষণ নিয়মিত দেখার সুযোগ হত না। আমার মতো পাঠকের জন্য রাধাপ্রসাদের সে লেখাগুলো এক মলাটের ফাঁকে এনে একটি মহান কাজ করলেন প্রকাশক সুবর্ণরেখা। গ্রন্থস্থ ২৩টি গদ্যখণ্ডের ২০টি ‘প্রতিক্ষণ’ পত্রিকায়, তিনটি অন্যত্র প্রকাশিত।

    তা পাঠক কেন পড়বেন রাধাপ্রসাদের লেখা এই বইটি? পড়া প্রয়োজন অন্তত দুটো কারণেঃ

    ১) নির্মল হাস্যরস কী ও তার সাথে রুচিহীন আদিরসযুক্ত ভাঁড়ামোর তফাৎ কোথায়, নিষ্পাপ রগড় কী এবং তা যে কত উন্নতমানের হতে পারে তা বুঝতে;

    ২) শেক্সপিয়র যে লিখেছিলেন ‘brevity is the soul of wit’ সে বাক্যের প্রকৃত অর্থ জানতেও পড়া প্রয়োজন রাধাপ্রসাদের লেখাগুলো।

    যে দক্ষতায় সৃষ্টি করেছেন ‘ভুবনেশ্বরের তৈরি ছেলে’ চরিত্র বা মিলিয়েছেন প্যারিস ও পটলডাঙা, তাতে আপসোস হয় কেন এত কম লিখলেন? কবিতা অনুবাদ করেছেন, কিন্তু তাঁর কাছ থেকে তো পাইনি গল্প-উপন্যাস-নাটক। এই গ্রন্থের নানা গদ্যখণ্ডে সংলাপ রচনায়, প্লট নির্মাণে, ছড়িয়ে রয়েছে তাঁর মুন্সিয়ানার পরিচয়, সৃষ্টিশীল মননের ছাপ; অসামান্য দক্ষতায়, সূক্ষ্ম আঁচড়ে ফুটিয়ে তুলেছেন শুভো ঠাকুরের চরিত্র, গোয়েন্দা গল্পের আদল ফুটেছে ‘উধাও ড্রাইভারের হদিশ’-এ; শাঁটুলবাবু আমাদের হাল্কা চালে শিখিয়েছেন ‘রেখে ঢেকে’ বলার কৌশল ও বিপদ।

    মধ্যদুপুরে কলকাতার ফেরিওয়ালার সেই মনকাড়া ডাক যেমন আর শুনি না, তেমন তাঁর কলমও গেছে থেমে মৃত্যুর আঘাতে। অল্প হলেও লেখা যা আছে তাই তাঁর পরিচয় বহন করবে ভাবীকালে। তাও কী হারিয়ে যাবে কালের আঘাতে? যেতেই পারে। হারিয়ে যাবার আগে তাই তাঁকে এবং তাঁর সময়ও সমাজকে চিনতে ও জানতে পড়তে হবে – হবেই, তাঁর লেখাগুলি।

    ২) গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের কার্টুনে হিন্দুত্ববাদ/ গ্রন্থনাঃ শুভেন্দু দাশগুপ্ত/ বইপত্তর. ইন/ প্রথম সংস্করণঃ জানুয়ারি ২০১৭

    গোড়াতেই পাই রবীন্দ্রনাথের মন্তব্যঃ “গগন খাঁটি স্বদেশী ও অত্যন্ত সাহসী।” বইটির পাতায় পাতায় মেলে রবীন্দ্র-উক্তির নির্ভুল সমর্থন।

    বইটিতে উদ্ধৃত রবীন্দ্র-উক্তির পরের পাতাতেই পাই গগনেন্দ্রনাথের কার্টুন প্রসঙ্গে কয়েকজন বিশিষ্ট মানুষের(যথা প্রাবন্ধিক নীরদ চৌধুরী, চিত্র সমালোচক অশোক মিত্র, সাহিত্যিক মুলক রাজ আনন্দ) কিছু টুকরো মন্তব্য। যা থেকে বোঝা যায় যখনই সমাজে নৈতিকতার সংকট তাঁর নজরে এসেছেন তখনই গগনেন্দ্রনাথ নির্দ্বিধায় তার প্রতিবাদ জানিয়েছেন – যে প্রতিবাদের অন্যতম মাধ্যম ছিল তাঁর এই সব কার্টুন।

    এ-কথা তো আমাদের জানাই যে, ছবি অনেক কথা বলে আর কার্টুন বলে আরও কিছু সত্য। এবং শিল্পীর নাম যদি হয় গগনেন্দ্রনাথ তবে তো কথাই নেই – সে পাওয়া অমূল্য ও চিরদিনের। তাই এমন একটা বই হাতে এলে তো প্রাণে খুশির হাওয়া বইবেই। বিশেষত এই সময় যখন রাষ্ট্রশক্তির প্রত্যক্ষ মদতে হিন্দুত্বের নামে কেউ কেউ আমার স্বদেশের, আমার সংস্কৃতির গলা চেপে ধরেছে, ধেয়ে আসছে হা রে রে রে ধ্বনিতে।

    মাত্র ৪৮ পাতার এই বইটি আমাদের তৃষ্ণা মেটাতে যথেষ্ট নয়, তবু বলতেই হয় যে ধর্ম-জাত-পাত নিয়ে আমাদের সমাজে যে হাস্যকর ধারণাগুলি শৃঙ্খলের মতো আমাদের চর্চা, আমাদের স্বভাব-অভ্যাস, আমাদের যাপনরীতি বেঁধে রেখেছে যুগে যুগে, যা আমাদের এক অন্ধকারের দিকে নিয়মিত ঠেলছে গগনেন্দ্রনাথের আঁকা ব্যঙ্গচিত্রগুলি তারই প্রতিবাদে আজও প্রাসঙ্গিক।

    তবু বলব, মন ভরেনি। যদি পাওয়া যেত অঙ্কিত কার্টুনগুলির সাল-তারিখ, নির্মাণের কাল, পরিবেশ, সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রতিক্রিয়া – চিত্রগুলি তবে বুঝি তার হৃদয়ের কথা বলে উঠত, প্রেক্ষিত স্পষ্ট হত। টীকা-ভাষ্য আছে বটে, কিন্তু তা যথেষ্ট নয়। আর যদি সরিয়ে নেওয়া না হত রঙিন ছবিগুলির রঙ! একথা সত্য যে গগনেন্দ্রনাথ সাদাকালোয় আঁকা তাঁর ছবিতে আলো-ছায়ার যে মহতী মায়া রচনা করেছেন তা অতুলনীয় এবং বুঝিবা অননুকরণীয়। তবু...

    এবং তারপরও বলব যা পেয়েছি তাও অনেক। কার্টুন তো নিছক ব্যঙ্গ নয় তা চিত্র (বিশেষত যদি কার্টুনিস্টের নাম হয় গগনেন্দ্রনাথ) এবং তা মানুষকে আঘাতে আঘাতে জাগিয়ে তোলে, বাস্তবের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়। বাংলার কার্টুনশিল্প স্বাধীনতার বহু আগে থেকে মানুষকে সচেতন হতে সাহায্য করেছে। আবার এখন মানুষকে অন্ধকারে ডুবিয়ে রাখার প্রয়াস চোখে পড়ছে। এই দুঃসময়ে গগনেন্দ্রনাথের আঁকা কার্টুনগুলি আবার আমাদের সামনে তুলে ধরে এক ঐতিহাসিক কর্তব্য পালন করলেন সমাজ-সচেতন অর্থনীতিবিদ ও গবেষক-অধ্যাপক শুভেন্দু দাশগুপ্ত।

    বঙ্গদর্শনের সপ্তাহের বাছাই করা ফিচার আপনার ইনবক্সে পেতে

    @