No Image

   

00:00
00:00
Volume

 0 Songs

    চা-বাগানে কয়েকদিন

    চা-বাগানে কয়েকদিন

    Story image

    টি-ট্যুরিজম বা চা-পর্যটন। পর্যটন শিল্পের এক নতুন দিক হিসেবে উঠে এসেছে খুব দ্রুত। যারা নির্জনে প্রকৃতির সঙ্গ পেতে চান, তাঁদের পক্ষে আদর্শ এই চা-পর্যটন। পশ্চিমবঙ্গে পাহাড়ে আর তরাই অঞ্চলে আছে সুবিস্তৃত চা-বাগান। এগুলোর অধিকাংশই তৈরি হয়েছে ব্রিটিশদের হাতে। পূর্ব হিমালয়ের আবহাওয়া যে চায়ের জন্য উৎকৃষ্ট, তা বুঝেই ব্রিটিশরা একরের পর একর জঙ্গল কেটে লাগিয়েছিল চা গাছ। আর এই চা বাগান ঘিরেই তৈরি হয়েছে জনবসতি। একদিকে ম্যানেজার, অন্যান্য উচ্চপদস্থ কর্মচারীদের জন্য তৈরি হয়েছে বিলাসবহুল রাজকীয় বাংলো, আরেকদিকে কুলিকামিনদের বস্তি। ব্রিটিশ শাসন শেষ হওয়ার সঙ্গে-সঙ্গেই বাগানের মালিকানাও বদল হয়েছে। যুগের সঙ্গে চা শিল্পকেও অনেক সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়েছে। মালিকেরা বুঝেছেন এই শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে হলে ব্যায়সংকোচ প্রয়োজন। আয় বাড়ানোর জন্য বিকল্প পথও খুঁজতে হবে। তারই ফল বোধহয় এই চা পর্যটন। পুরোনো ব্রিটিশ আমলের বাংলো খুলে দেওয়া হয়েছে পর্যটকদের জন্য। কোথাও কোথাও চা শ্রমিকেরাও তাঁদের বাড়িতে ব্যাবস্থা করেছেন ‘হোম-স্টে’র। বাগানের মধ্যে থেকে এক অন্য জীবনধারার ঘ্রাণ পাওয়া, আর চারিধারে সবুজের মধ্যে নিজেকে হারিয়ে ফেলা – এর চেয়ে ভালো আর কিছু হয় নাকি?

    এরকমই একটি চা-পর্যটন বাংলোর নাম হল ‘দ্য লাস্ট মাইল’। কালিম্পং জেলার লাভা থেকে ৯ কিলোমিটার দূরে সামাবিয়ং চা বাগান। এদের ১০০ বছরেরও বেশি পুরোনো এক ব্রিটিশ ম্যানেজারের বাংলোকে ঘিরে তৈরি হয়েছে পর্যটন ব্যবস্থা। বাংলোর ভিতরে ঢুকেই মনে হয় সময় যেন থমকে দাঁড়িয়ে রয়েছে। উঁচু সিলিং-এর বিশাল বসার জায়গা সাবেকি আমলের আসবাবে সজ্জিত। ঘরের কোণে ফায়ারপ্লেসের পাশে নিচু টেবিলে রাখা আছে দাবা বোর্ড, উপর থেকে ঝুলছে এক গ্র্যান্ডফাদার ক্লক যার উপরে লেখা সালটা হল ১৭৪৭, এখনো নিখুঁত সময় দিয়ে যাচ্ছে। বাংলোর ঐতিহ্য বজায় রেখে করা হয়েছে কিছু আধুনিকীকরণ, কিন্তু নজর রাখা হয়েছে কোথাও যেন কোনও অসংগতি চোখে না পড়ে। পুরো সাজসজ্জাতেই সুরুচির ছাপ, উচ্চগ্রামে বৈভবের ঘোষণা কোথাও নেই। খোলা বারান্দায় বসে তাকিয়ে থাকুন যেখানে নীলদিগন্ত সবুজ চা-গালিচায় মিশেছে, হাতে থাকুক এই বাগানেরই সুরভিত চা। চাইলে এদের ছোট্ট কিন্তু সুনির্বাচিত বইয়ের সংগ্রহ থেকে পছন্দের বই পড়েই কাটিয়ে দিন সারাটা দিন। আর পায়ে হেঁটে বেড়ান যেমন খুশি পাহাড়ি গ্রামের পথে, চা বাগানের মধ্যে দিয়ে, সব জায়গাতেই পাবেন এদের সহাস্য মুখের ঊষ্ণ অভ্যর্থনা।

     

    বাংলোর ম্যনেজার এক সপ্রতিভ নেপালি যুবক। তিনি জানালেন, এখানে দুরকমের পর্যটন ব্যবস্থা আছে। এক, তিনদিনের প্যাকেজ। প্যাকেজে আছে কাছের দ্রষ্টব্য স্থান-লাভা, লোলেগাঁও ইত্যাদি ভ্রমণ, চা কারখানায় গিয়ে চা তৈরির পদ্ধতি দেখা, নেওড়া ভেলির জঙ্গলের পথে গাইড-সহ হাঁটা, পাখি দেখা, স্থানীয় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান দেখা, ভ্রমণ শেষে ক্যাম্প-ফায়ার ইত্যাদি। দুই, আপনি নিজেই নিজের ব্যবস্থামতো ঘুরতে পারেন দ্রষ্টব্য স্থানে।

    আমাদের থাকাকালীন আরেক অভিজ্ঞতার কথা না বললেই নয়। সকাল থেকেই বাংলোয় সাজোসাজো রব, শুনলাম মালিক আসছেন সপরিবারে। আমরা কিছুটা ত্রস্তই ছিলাম, একেবারে খোদ মালিক! কিন্তু আমাদের সব আশঙ্কা অমূলক করে এলেন এক তরুণ। শান্ত, সপ্রতিভ। আলাপে জানলাম লন্ডন স্কুল অফ ইকনমিক্স এর স্নাতক, পরে কৃষিবিজ্ঞানে ডিগ্রি অর্জন করেছেন। নববিবাহিতা স্ত্রী ইন্টিরিয়র ডিজাইনার, বাস কলকাতা। সহজেই আপন করে নিলেন। তাঁদের কাছে শুনলাম এই চা বাগানের ইতিহাস। ১৮৮২ সালে ব্রিটিশের হাতে এই চা বাগানের পত্তন। তারপর বহুবার মালিকানা বদল হয়েছে এই বাগানের। ১৯৬০ সাল থেকে এই বাগান হতে থাকে জীর্ণ। ১৯৮০র মাঝামাঝি পাহাড়ে রাজনৈতিক অস্থিরতার রেশ পড়ে বাগানে, চা তৈরির কারখানা সম্পূর্ণ ভস্মীভূত হয়, বন্ধ হয়ে যায় বাগান। ১৯৯০তে বর্তমান মালিকের দাদু কিনে নেন এই পরিত্যক্ত বাগান এবং সামাবিয়ং গ্রামের লোকেদের সাথে নিয়ে পুনরুজ্জীবিত করেন একে। তারপর থেকেই চলছে এগিয়ে যাওয়া। গতবছর রাজনৈতিক অস্থিরতায় কিছুটা থমকে গেছিল, কিন্তু এখন আবার ঘুরে দাঁড়িয়েছে। এঁদের লক্ষ্য হল পরিবেশ-বান্ধব চা-শিল্প গড়ে তোলা। এই বাগান পুরোপুরি জৈবপদ্ধতি নির্ভর। গর্বিত স্বরে আরো জানালেন, পুরো গ্রামে কোনো চাষেই ব্যাবহার হয় না কোন রাসয়নিক সার। সামাবিয়ং এর চা-ও অতি উৎকৃষ্ট মানের, তবে তা সাধারণের নাগালে আসে না। পুরোটাই রপ্তানি হয় জার্মানিতে। এখানে থাকলে অবশ্য স্বাদ পাবেন এই চায়ের।

    তরুণ মালিকের চোখে অনেক স্বপ্ন –এখনো পথ বাকি আছে। শিক্ষা, স্বাস্থ্যের আরো সুযোগ করে দিতে হবে গ্রামবাসীদের। আশা করতে দোষ নেই – সামাবিয়ং হয়ে উঠবে এক আদর্শ গ্রাম।

    কীভাবে যাবেন - 
    ট্রেনে নিউ জলপাইগুড়ি বা মাল জংশন থেকে গাড়িতে গরুবাথান হয়ে লাভা যাওয়ার পথে লাভার ৯কিলোমিটার আগে পড়বে এই সামাবিয়ং চা বাগান। নিউ জলপাইগুড়ি থেকে সময় লাগে সাড়ে তিন ঘণ্টা, মাল থেকে আরো কম। বাগডোগরা এয়ারপোর্ট থেকেও একই পথে যাওয়া যায়।
    বাংলো বুকিং হয় অন-লাইনে। www.ourlastmile.com. হল এদের ওয়েবসাইট।

     

    বঙ্গদর্শনের সপ্তাহের বাছাই করা ফিচার আপনার ইনবক্সে পেতে

    @