No Image

   

00:00
00:00
Volume

 0 Songs

    দুই মেয়ের মৃত্যু ও রবীন্দ্রনাথ

    দুই মেয়ের মৃত্যু ও রবীন্দ্রনাথ

    Story image

    বড় জেদি মেয়ে রাণী। বুকে কখন যেন বাঁধিয়ে বসেছে মারণরোগ। যক্ষ্মা। তখন যক্ষ্মা হলে ফিরে আসত না প্রায় কেউই। তবু, তাঁকে নিয়ে যাওয়া হল আলমোড়ায়। হিমালয়ের হাওয়া যদি সারিয়ে তুলতে পারে। কিন্তু, জেদি মেয়ের আবদার “বাবা, বাড়ি নিয়ে চলো।” ক্রমে নিভে আসছে রাণী। কিছুই আর করার নেই বুঝে ফিরিয়ে আনা হল কলকাতায়। এ শহর এমনিতেই বিষের, ধোঁয়ার, দূষণের। সে যতই হোক না কেন একশো বছর আগের কলকাতা। ফেরার পর যখন বোঝা গেল, রাণীকে কিছুতেই রাখা যাবে না বেশিদিন, তখন বাবা তাঁকে শোনাতেন ‘শিশু’র কবিতা। রাণীও শিশুরই মতো। অবুঝ, সরল। কিন্তু, এভাবে কি যেতে দেওয়া যায়! তাই নিজেকে শক্ত করে ঐ সামান্য কিশোরীকেও উপনিষদ পড়ে শোনাতেন তাঁর বাবা। এক বিরাট মাপের মানুষ। যন্ত্রণা বুকে চেপেও স্থির, দার্শনিকপ্রতিম। তাই হয়ত যাওয়ার সময় বাবার হাত চেপে ধরেই রাণী বলেছিল, “সব অন্ধকার হয়ে আসছে। কিছু যে দেখতে পাচ্ছি না। বাবা তুমি পিতা নোহ সি মন্ত্র পড়ে শোনাও।”

    রাণী বা রেণুকা। রবীন্দ্রনাথের মেজো মেয়ে। বাবার হাত চেপে ধরেই জীবনের সিংহদরোজা পেরিয়ে যেতে চেয়েছিল সে। যাওয়ার আগে শেষ আবদারও বাবারই কাছে। “বাবা... মন্ত্র পড়ে শোনাও।”

    আর, পিতা রবীন্দ্রনাথ? চোখের সামনে মেয়ের ফুরিয়ে আসা দেখেও যিনি নিজেকে জড়ো করেছেন রোজ। কোত্থেকে পেলেন এই অমানুষিক সহ্যশক্তি? উত্তর পাওয়ার কোনও উপায় নেই। আমরা তাঁর মানসপৃথিবীকে তন্ন তন্ন করে খুঁজে দেখতে পারি। দেখব অনন্তের কাছে, মুক্তির কাছে, জীবনের তুচ্ছতার কাছে, দর্শনের কাছে নতজানু একজন কেবলই নিজেকে সংযত করছেন। সমস্ত হারিয়ে যাওয়ার উল্টোপিঠে বলেই চলেছেন ‘আছে আছে আছে।’

    কিন্তু সন্তানশোক কি এত সহজে নিরাময় হয়? এই নিস্পৃহ, জেদি, খেয়ালি কন্যাটি কবির বড় আদরের। তাঁর সাজতে মোটেও ভাল্লাগতো না, চুল বাঁধা নিয়ে তো প্রবল বিরক্তি। যেদিন মেয়ের বিয়ে ঠিক করে এলেন রবীন্দ্রনাথ, ফিরেই বউকে বললেন, “রাণীর বিয়ে ঠিক করে এলুম... ছেলেটিকে আমার বড় ভাল লেগেছে ছোট বউ... রাণীটা যে জেদি মেয়ে, ওর বর একটু ভালমানুষ গোছের না হলে চলবে কেন?” বরকে অবশ্য মোটেও খুব পছন্দ হয়নি রাণীর। বিয়ের পরই বর পড়তে যাবে বিলেত। রাণী খুশি, বরের সঙ্গে থাকতে হবে না। কিন্তু এই স্বামীই যখন ফেল করে আমেরিকা থেকে ফিরছেন, তাও বড় আঘাত হয়ে রাণীর বুকে বাজল। মা মৃণালিনীদেবী মারা গেছেন কদিন আগেই। এই দুই আঘাতই কি বুকের অসুখে জমাট হয়ে ছিল?

    রাণী চলে গেল। তার কদিন আগেই চলে গেছেন স্ত্রী। মৃত্যু কিন্তু এত সহজে রেহাই দিল না রবীন্দ্রনাথকে। সেই দাবাখেলায় এরপরের শিকার প্রথম সন্তান মাধুরীলতা। কবির বড় আদরের বেলা, বেলি বা বেলুবুড়ি। বেল ফুল কবির বড় প্রিয় বলে তাঁর বড় মেয়ের অমন নাম রেখেছিলেন বৌদি জ্ঞানদানন্দিনী। মেয়ের মৃত্যুর সমাপতনে ফের মিলে যায় পিতার ভূমিকা। মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও বারবার মেয়ের মাথার পাশটিতে এসে বসা। আর, অসুখে তিলে তিলে ক্ষইতে থাকা মাধুরী তখন শীর্ণ দুটি হাত বাড়িয়ে রবীন্দ্রনাথকে ছোট্টবেলার মতো আবদার করছেন—“বাবা গল্প বলো”। ফের মৃত্যুপথযাত্রী এক মেয়েকে ফের গল্প শোনাচ্ছেন অসহায় পিতা। রাণী শুনেছিল ‘শিশু’র কবিতা, ছোট ছেলের গল্প আর মাধুরী শোনে ‘পলাতকা’র বিনুর গল্প, ‘মুক্তি’, বামির কথা। তারপর গল্প শোনা শেষ, গল্প বোনাও। একই ভূমিকায় রবীন্দ্রনাথকে কেন বারবার টেনে আনে সময়?

    মাধুরী তাঁর প্রথম সন্তান। তাই তাঁকে মনের মতো করে মানুষও করতে চেয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। বাড়িতে শিক্ষক রেখে পড়ানো, দেশি-বিলিতি গান শেখানো, মায় নার্সিং পর্যন্ত শিখিয়েছিলেন তাঁকে। কিন্তু, এই আদরের বড় মেয়েই বাবার প্রতি এক গভীর অভিমান বয়ে বেরিয়েছে আমৃত্যু। তারপর চিরতরে চলে গেছে। কন্যার মৃত্যুশোকের পাশাপাশি এই অভিমানও রবীন্দ্রনাথকে আঘাত করেছে আরও তীব্রতায়, আরও গভীরে।

    অভিমান কেন? তা নিয়ে অনেক অনেক পাতার আলোচনা, গুজব, কল্পিত কাহিনি। এ লেখায় সেই তিক্ত ইতিহাসের পর্দা সরিয়ে ঢুঁ নাই বা মারলাম। এসব ছাপিয়ে বরং বারবার ফিরে দেখতে ইচ্ছে হয় অসহায় পিতা রবীন্দ্রনাথকে। অভিমান করে ঠাকুরবাড়ি ছেড়ে ডিহি শ্রীরামপুরের ভাড়াবাড়িতে উঠে গেলেন মাধুরী ও শরৎ। তখন রবীন্দ্রনাথ এ দেশে নেই। সব শুনে চিঠি লিখলেন মেয়েকে, জামাইকে। মেয়েকে লিখলেন, “আমাদের সম্বন্ধে তোদের মনের সমস্ত গ্লানি ধুয়ে ফেলে দে”। অহঙ্কার, মর্যাদাবোধের তোয়াক্কা না করে জামাইকে লিখলেন, “আমার মধ্যে সে রকম ত্রুটি যদি তোমরা দেখে থাক, তা হলে সে কি তোমরা কোনো মতেই ক্ষমা করতে পারবে না।” কিন্তু এতকিছুর পরেও অভিমান সম্পূর্ণ ভাঙেনি। জামাই শরতের সঙ্গে নাকি আর মুখোমুখি সাক্ষাতই হয়নি কখনও কবির।

    কিন্তু, অসুস্থ মেয়েকে দেখতে রবীন্দ্রনাথ বারবার ছুটে গেছেন তাঁর বাড়ি। প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশকে বলেছেন, “কিছুই তো করতে পারতুম না। অনেকদিন ধরেই জানতুম যে ও চলে যাবে। তবু রোজ সকালে গিয়ে ওর হাতখানা ধরে বসে থাকতুম।” যদিও এত শান্ত থাকতে পারেননি ভিতরে। ভেঙে যাচ্ছিলেন। রথীন্দ্রকে লিখলেন, “জানি বেলার যাবার সময় হয়েছে। আমি গিয়ে তার মুখের দিকে তাকাতে পারি এমন শক্তি আমার নেই।” তাও, গল্প শোনানোর আবদার আসে। মৃত্যুপথযাত্রী মেয়ের আবদার ফেরাতে পারেন না বাবা। মেয়ের যে অনেক অভিমানও তাঁকে নিয়ে।

    এরপর যেদিন বেলা চলে গেল, তা শুনে বাড়ির নীচ থেকেই প্রায় ঘোরের মধ্যে বেরিয়ে এসেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। মেয়েকে শেষবার দেখতেও চাননি। আর যে গল্প শোনানোর দায় নেই। মুক্তি। এই মুক্তি কোনও বাবাই চান না। অথচ, রবীন্দ্রনাথকে কোনও এক হেঁয়ালিতে বারবার এমনই নেতিময় মুক্তিতে এনে দাঁড় করায় জীবন। দুই মেয়ে এবং শেষে প্রাণাধিক প্রিয় ছোট ছেলে শমীন্দ্রনাথ। আঘাতের পরে আঘাত। সন্তানশোক...

    সেই যন্ত্রণার ভার নিজের সৃষ্টি ছাড়া আর কাকেই বা দিয়ে যেতে পারতেন রবীন্দ্রনাথ!

    বঙ্গদর্শনের সপ্তাহের বাছাই করা ফিচার আপনার ইনবক্সে পেতে

    @